সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:০৭:৩৬

জানেন এবার বিনামূল্যে বাংলাদেশকে কী দিতে যাচ্ছে চীন?

জানেন এবার বিনামূল্যে বাংলাদেশকে কী দিতে যাচ্ছে চীন?

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : এবার বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) ঘাটতির সমস্যা দীর্ঘদিনের। প্রায় প্রতিদিনই পুরনো ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে, যাত্রীসেবায় ভোগান্তি তৈরি করছে। এ অবস্থায় চীনের অনুদানে ২০টি নতুন মিটার গেজ লোকোমোটিভ আনতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব অনুমোদনের অপেক্ষায়। হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের জন্য চীনের এটি একটি বড় অনুদান হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এর আগে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ রেলওয়েকে ২০টি পুরনো লোকোমোটিভ দিয়েছিল ভারত। আলোচিত প্রকল্পটি নির্বিঘ্নে সময়মতো বাস্তবায়ন হলে শুধু লোকোমোটিভ সংকটই কিছুটা কাটবে না, বরং জ্বালানি সাশ্রয় ও নিরাপদ চলাচলও নিশ্চিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কাছে রেল মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে ‘প্রকিউরমেন্ট অব ২০ মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভস ফর বাংলাদেশ রেলওয়ে আন্ডার চায়না গ্রান্ট’ শীর্ষক প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে। প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) দ্রুত অনুমোদনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

পিডিপিপি অনুযায়ী, পুরো প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা (প্রায় ১৩৩ মিলিয়ন ডলার)। এর মধ্যে চীন এক হাজার ৫৯১ কোটি টাকা (১২৯ মিলিয়ন ডলার) দেবে অনুদান আকারে। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দেবে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা (৩.৫৮ মিলিয়ন ডলার)। জানুয়ারি ২০২৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২৭ পর্যন্ত দুই বছরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রকল্পের আওতায় শুধু লোকোমোটিভই নয়, বরং প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রশিক্ষণ সুবিধাও পাওয়া যাবে, যাতে রেলওয়ের প্রকৌশলী ও মেকানিকরা প্রযুক্তিগত জ্ঞানার্জন করতে পারেন। জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান লোকোমোটিভ পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বর্তমানে মোট লোকোমোটিভ আছে ৩০৬টি, এর মধ্যে ১৭৪টি মিটার গেজ ও ১৩২টি ব্রড গেজ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিটার গেজ বহরের বেশির ভাগ ইঞ্জিনই আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে। সরকারি নথি বলছে, ১২৪টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ অর্থাৎ মোট বহরের ৭১ শতাংশই নকশাগত আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে।

এর মধ্যে ৬৮টি ইঞ্জিন টানা ৪০ বছর ধরে চলছে, আর ৮৪টি ৩০ বছর পার করেছে। এত পুরনো ইঞ্জিন চালানো এখন রেলওয়ের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রেলওয়ের প্রকৌশলীদের ভাষায়, এসব পুরনো ডিজাইনের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক সময় উচ্চমূল্যে বিদেশ থেকে আনতে হয়। তার পরও মেলে না প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ। ফলে ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ে ইঞ্জিনগুলো। দক্ষতা কমে যাওয়ায় অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ হচ্ছে, বাড়ছে রক্ষণাবেক্ষণ খরচ। একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার বক্তব্য, ‘পুরনো ইঞ্জিনের আউটপুটের তুলনায় মেরামত ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফলে নির্ভরযোগ্যতা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।’

এ অবস্থায় নতুন লোকোমোটিভ না এলে পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলের মিটার গেজ সেকশনে কিছু ট্রেন বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ দৈনন্দিন চলাচলের জন্য যত লোকোমোটিভ দরকার, তা নেই। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ‘ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিটি-৫২)’ অনুসারে শুধু মিটার গেজ সেকশনের জন্যই দরকার ছিল ২০৩টি লোকোমোটিভ, যেখানে সংরক্ষণ হিসেবে ২৫ শতাংশ অতিরিক্ত ধরা হয়েছিল। অথচ বর্তমানে সক্রিয় লোকোমোটিভ আছে মাত্র ১৮২টি। অর্থাৎ ঘাটতি অন্তত ২১টি। বাস্তবে চাহিদা আরো বেড়েছে, কারণ যাত্রী ও মাল পরিবহনের চাপ গত পাঁচ বছরে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর ফলে আন্ত নগর যাত্রীসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্থানীয় ও মালবাহী ট্রেনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আবার লোকোমোটিভ সংকটের কারণে নির্ধারিত ওভারহোলিং বা রক্ষণাবেক্ষণ কাজ পিছিয়ে দিতে হচ্ছে, এতে বর্তমান লোকোমোটিভগুলো বিকল হওয়ার ঝুঁকিতে। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যাত্রী পরিবহনে রেলের অংশ ১০ শতাংশ ও মাল পরিবহনে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে নতুন লোকোমোটিভ অপরিহার্য। রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপে (২০১৭-২১) ৭৪টি লোকোমোটিভ প্রতিস্থাপন ও ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ ছিল। কিন্তু এত দিনে কেনা গেছে মাত্র ৩০টি। আর্থিক সংকটে ২০১১ সালে ৭০টি লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনাও বাতিল হয়। ফলে পুরনো লোকোমোটিভের ওপর নির্ভর করেই চলছে রেলওয়ে সেবা।

চীনের এই অনুদানভিত্তিক প্রকল্পকে তাই রেলওয়ের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আধুনিক ডিজেল-ইলেকট্রিক লোকোমোটিভগুলো শুধু নতুন ট্রেন চালুর সুযোগই তৈরি করবে না, বরং জ্বালানি সাশ্রয় করবে, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কমাবে এবং নির্ভরযোগ্যতা বাড়াবে। ফলে আয়ও বাড়বে। তবে রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল ২০টি ইঞ্জিন দিয়ে চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। রেলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পূরণে আরো বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন। রেলের দুই-তৃতীয়াংশ মিটার গেজ ইঞ্জিন যখন আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে, তখন সময়মতো নতুন লোকোমোটিভ না আনলে রেল চলাচলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। নির্ভরযোগ্য পরিবহন সেবাদাতা হিসেবে রেলওয়ের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এদিকে ইআরডির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চীনের অনুদানে ২০টি মিটার গেজ লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্প রেলওয়ের জন্য তাৎক্ষণিক সহায়তা হলেও এতে ঝুঁকি রয়েছে। অতীতে চীন অর্থায়িত প্রকল্পে দেরি, ব্যয় বৃদ্ধি ও স্বচ্ছতা ঘাটতির অভিজ্ঞতা আছে। নতুন প্রকল্পেও টেন্ডার বিলম্ব, নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ও ঠিকাদার চাপিয়ে দেওয়া, খুচরা যন্ত্রাংশ ও জনবল ঘাটতির ঝুঁকি উপেক্ষার নয়। এ জন্য ফিজিবিলিটি স্টাডি, স্বচ্ছ ক্রয়, প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট নিশ্চিত করা জরুরি। সময়মতো বাস্তবায়ন হলে রেলওয়ের যাত্রী ও মালবাহী পরিবহনের সক্ষমতা বাড়বে।

এ বিষয়ে ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, রেল খাতের লোকোমোটিভ সংকটের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরে আলোচনা হয়েছিল। তারই আলোকে একটি প্রাথমিক প্রস্তাব তৈরি করেছে রেল। পরিকল্পনা কমিশন প্রস্তাব অনুমোদন করলে সেই প্রস্তাব ইআরডি আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কাছে তুলে ধরবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি রেলসচিব ফাহিমুল ইসলাম।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে