ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ আমাদের মাঝে হাজির হয় সত্য ও সুন্দরের জয়গান নিয়ে।অন্তত: এই দিনে ধনী-দরিদ্র, শিশু-কিশোর, যুবা-বৃদ্ধ সবার মনেই বয়ে যায় আনন্দের ধারা। কিন্তু এবার কি সত্যিই আমরা সবাই ঈদের সেই আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছি? এর জবাব বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।
কেননা, এবারের ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ। পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম- ঈদ উদযাপনের পরিবর্তে ঈদের দিনেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন মেডিকেল ভর্তিচ্ছু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এনে ভর্তি পরীক্ষার ফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার দাবিতে ঈদের দিন বিক্ষোভ করেছেন। আজ রোববারও দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন। এছাড়া দাবি আদায় না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারিও দিয়েছেন তারা। তরুণ সমাজের একটি অংশকে মাঠে রেখে ইতোপূর্বে কোনো ঈদ আমাদের দেশের উদযাপিত হয়েছে কি না তা আমার জানা নেই।
অন্যদিকে ঈদের একদিন আগে (২৩ সেপ্টেম্বর) আমরা লক্ষ্য করলাম- রংপুরে আন্দোলনরত মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছু পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর হামলা করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মি ও তাদের সহযোগীদের হামলায় নারী শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এমন কি শিক্ষার্থীদের প্যান্ট খুলে নগ্ন করারও চেষ্টা করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের এমন হীন কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।
দৃশ্যত ঈদের দিন শহীদ মিনারে মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবাদ করলেও সারাদেশে তাদের সংখ্যাটা একেবারে কম নয়। এছাড়া সহজেই অনুমেয়, মানুষ কখন ঈদের আনন্দ ছেড়ে ঈদের দিনেও আন্দোলনে করতে বাধ্য হয়। ফলে এবারের ঈদে তরুণ জনগোষ্ঠীর একাংশের হৃদয়ে যে আনন্দের ছুঁয়া লাগেনি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আনন্দের পরিবর্তে তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা-হতাশায় দিনাতিপাত করছেন। এই তরুণ জনগোষ্ঠীর কারণে তাদের অভিভাবকদেরও ঈদ ভালো কাটেনি।
গেল ১৮ সেপ্টেম্বর জীবনের বহুল কাঙ্খিত যে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল তাতে তরুণদের আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনি। মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি বলে এর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ নিয়ে সরকার যাই দাবি করুক না কেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি একেবারেই অমূলক নয়। কেননা, এই অভিযোগে ইতোমধ্যে শিক্ষক, চিকিৎসক ও ইউজিসির কর্মকর্তাসহবেশ বেশ কয়েকজনকে ২১ লাখ নগদ অর্থ, কোটি টাকার চেক ও অন্যান্য প্রমাণাদিসহ আটক করা হয়েছে। এছাড়া প্রশ্নপত্র যে ফাঁস হয়েছে তা প্রমাণের জন্য একজন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর টেলিভিশন সাক্ষাৎকারই যথেষ্ট হতে পারে যদি তা আমলে নেয়া হয়। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা কোন ধরনের তদন্ত ছাড়াই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করছেন।
ফলে এ নিয়ে গণমাধ্যম তথা বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা মাঠে আন্দোলন করে আসছেন। তারা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-সমাবেশ ও মানবন্ধন করে আসছেন। দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্নমহল থেকেও পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষার দাবি করা হচ্ছে। কিন্তু সরকারের সংশ্লিষ্টরা কোনোভাবেই এসব আমলে নেয়নি। তারা এই বিতর্কিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করছে।
প্রসঙ্গত, এবার আমার দুই নিকটাত্মীয়ও মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। কিন্তু ফলাফলে তাদের চান্স হয়নি। তাদের বক্তব্য হলো- প্রশ্নপত্র ফাঁস না হলে তারাও ভর্তির সুযোগ পেতেন। এতে ঈদ আনন্দের পরিবর্তে গেল ক'দিন ধরে তাদের পরিবারে চলছে এক অন্যরকম শোক। এরকম অবস্থা অনেক পরিবারেই চলছে।
এটা আমাদের গোটা জাতির জন্য বেদনাদায়ক। কেননা, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি নতুন নয়, গেল কয়েক বছরে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, বিগত কয়েক সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা, এমন কী বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু বরাবরই সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগটি আমলে নেয়া হয়নি, সেই সাথে এর প্রতিকারে আশাপদ কোন পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়নি।
সেইসাথে চাকরিক্ষেত্রেও বৈষম্য এখন প্রকট ।সাম্প্রতিককালে অধিকমাত্রায় সর্বক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের ফলে বিসিএস পরীক্ষাও দলীয়করণের অভিযোগ উঠেছে।যা সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার বক্তব্যই তা প্রমাণ করে ‘লিখিত পরীক্ষা ভাল করে এসো' বাকীটুকু আমরা দেখবো’। এ নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (বিপিএসসি) অধীনে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পরও নিয়োগ পাচ্ছেন না চাকরি প্রার্থীরা। এতে লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিত মেধাবী বেকার তরুণ মানবেতর জীবন যাপন করছে। দেশে শিক্ষিত বেকাত্বের বিপদসীমা এখন ছুঁই ছুঁই করছে। এসব কিছুর মূলে দুর্নীতি জাতিকে গ্রাস করছে। দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণা সূচকেও বাংলাদেশে দুর্নীতি বেড়েছে। এতের সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী, পদক্ষেপ হতাশাব্যঞ্জক নয়। ফলে শিক্ষাসেক্টরেও এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে।
তাই পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই আজ খুবই উদ্বিগ্ন। আমরা জানি- 'শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ কোনো জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রথমে তার মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করতে হয়। কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক বিশ্ব প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া তো দূরের কথা, নানা অনিয়ম আর চরম দৈন্যতায় হাবুডুবু খাচ্ছে! জাতিকে মেধাশূণ্য তথা ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সেদিক থেকে এগুলো জাতির জন্য এক অশুভ ইঙ্গিত। তাই সরকারের উচিত হবে অভিযোগটি আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা। অন্যথা প্রশ্নফাঁসের প্রশ্নবিদ্ধ এই পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি নেয়া হলে জাতির ঘাড়ে আরেকটি কলঙ্ক লেপন হবে। সেই সাথে মেডিকেল শিক্ষার ইতিহাসে এটি একটি মন্দ নজীর হয়ে থাকবে।
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ