বুধবার, ১২ এপ্রিল, ২০১৭, ০৭:১৬:৫৬

এবার আশরাফুল ভক্ত বা নিন্দুকদের জন্য সুসংবাদ

এবার আশরাফুল ভক্ত বা নিন্দুকদের জন্য সুসংবাদ

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়: বিগত ২১ বছরে কত হাজার ইনিংস দেখেছি গুনে বলা অসম্ভব। তবু চোখ বন্ধ করে কোনো ইনিংস মনে করতে গেলে প্রায় প্রতিবারই ২০০৪ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে আশরাফুলের ১৫৮ রানের ইনিংসটা চলে আসে।

ব্রায়ান লারা, টেন্ডুলকার, সাঈদ আনোয়ার, মার্ক ওয়াহ, পিটারসেন, কোহলি, ক্যালিস, পন্টিং- বিশ্বক্রিকেটের চোখধাঁধানো ব্যাটসম্যানদের প্রত্যেকের অসংখ্য ভালো ইনিংস দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু খুব অদ্ভুত লাগে যখন ওয়ানডে-টেস্ট মিলিয়ে একটিমাত্র ইনিংসের কথা চিন্তা করলে বিস্ময়কর রকম অধারাবাহিক এবং ২০-২২ গড়ের এক ব্যাটসম্যান আশরাফুলই বারবার ফিরে আসে। হায় আশরাফুল!

আশরাফুলকে নিয়ে লেখালিখির বিপদ বিস্তর।

একদল, আশরাফুলের অন্ধভক্ত , আরেকদল আশরাফুল নামটা শুনলেই চরম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। যেকারণে আশরাফুলকে নিয়ে লেখা কোনো আর্টিকেল পুরোটা পড়ে, এই সংখ্যা খুবই নগণ্য; প্রথম কয়েক লাইন পড়েই সিদ্ধান্তে চলে আসে এখানে আশরাফুলের প্রশংসা, নাকি নিন্দা করা হয়েছে; তারপর প্রতিক্রিয়াশীলতার পরাকাষ্ঠা হয়ে কী-বোর্ডযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কিংবা ক্রিকেটপ্রজ্ঞার ঝুলি বয়ে নিয়ে সযত্নে লেখাটি উপেক্ষা করে তৃপ্তি লাভ করে । আমার এই লেখার ক্ষেত্রেও অভিন্ন পরিণতি পাবো ধরে নিয়েই বাকিটুকু লিখতে চাই। হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে অতিমাত্রায় ইন্টারেস্টেড হওয়ার কারণে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আশরাফুল একটি বিশাল স্পোর্টস সাইকিক এনালাইসিসের খুবই ভাইটাল কেস স্টাডি হতে পারে।

ক্রিকেট যদি নিছক পরিসংখ্যাননির্ভর খেলা হয়, তাহলে আশরাফুলকে আমলে নেয়ারই কোনো কারণ নেই। এবং ক্যারিয়ার স্ট্যাট ঘেঁটে নির্দ্বিধায় তাকে একজন ‘ওভাররেটেড প্লেয়ার’ হিসেবে রায় দিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু, ক্রিকেটকে যদি নন্দনতত্ত্বের বা ফাইন আর্টসের সাবজেক্ট হিসেবে চিন্তা করা যায়, সেখানে আশরাফুলকে উপেক্ষা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

ক্রিকেট তো আদতে পারফরমিং আর্টসই। বোলার যেভাবে দৌড়ে এসে কোনো একটি একশনে বল ডেলিভারি দেয়, সেই বল কোনোটা লেগে, কোনোটা মিডল স্ট্যাম্পে পিচ করে, এবং ব্যাটসম্যান যখন বলটা খেলে তারও একটি বিশেষ ভঙ্গি থাকে, এবং মুহূর্তের মধ্যে বলটা হাওয়ায় ভাসে, কখনো মাটি কামড়ে যায়- সমগ্র প্রক্রিয়াটি সাংঘাতিক জটিল এবং খুবই নিখুঁত পারফেকশন দাবি করে। সার্কাসে দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটা দেখে যেমন আমরা বিমোহিত হই, ক্রিকেট খেলাটা তার চাইতেও অনেক বেশি কমপ্লিকেটেড। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং সবকিছুর মধ্যে একটা রিদম আছে, সারেগামাপা এর মতো স্বরগাম আছে। যে কারণে এক্ই ব্যাটসম্যান কোনো ম্যাচে সেঞ্চুরি করে, পরের ইনিংসেই শূন্য রানে আউট হয়। একই বোলার ৪-৫ উইকেট পায়, পরের ম্যাচেই হয়তোবা ৪০-৫০ রান দিয়ে উইকেটশূন্য থাকে।

আশরাফুলের ব্যাপারে বলতে গেলে ক্রিকেটের চাইতে আর্টসই বারবার প্রাসঙ্গিক হয় তাই। যেমন, ভূপেন হাজারিকার কথা বললেই ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটা রেফারেন্স হিসেবে চলে আসে। তিনি আরও অসংখ্য কালজয়ী গান গেয়েছেন, তবু ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গানটাই তার সত্তার প্রতিরূপ হয়ে আছে। কিংবা একজন কবি জীবনে হয়তোবা একটিমাত্র পাওয়ারফুল কবিতা লিখেছেন, বাকি জীবনে আর উল্লেখযোগ্য কিছুই লিখতে পারেননি। এই মানুষগুলোকে কীভাবে মূল্যায়ন করা হবে?

‘আমরা করবো জয়’ এই একটা লাইন যতখানি প্রভাব বিস্তার করেছে বিশ্বজুড়ে, যিনি এটা লিখেছিলেন সমগ্র জীবনে তিনি হয়তো আরও অনেক লিখেছেন, সেগুলো কোথায় গেলো!

আমাদের বস্তুবাদী পৃথিবী খুবই নির্মম। এখানে কনভারশন এবিলিটিই শেষ কথা; কী হতে পারতো, তার চাইতে কী হয়েছে, এটাই কংক্রিট সত্য। যে ট্যালেন্ট পারফরম্যান্সে রূপ পায় না, সেই ট্যালেন্টের আদতে কোনো মূল্যই নেই।

১২ বছরের ক্যারিয়ারে ১০০ এর অনেক বেশি ম্যাচ খেলে যে ব্যাটসম্যানের গড় মাত্র ২০-২২, তাকে কোনোভাবেই ট্যালেন্টেড হিসেবে মেনে নেওয়ার যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে না। আমাদের ডিসিশন মেকিং বরাবরই মেথডোলজিকাল, সেখানে মেজারমেন্ট প্যারামিটার লাগবে, ডাটা, রেফারেন্স লাগবে; বিজনেস ওয়ার্ল্ড আমাদের তিনটি অদ্ভুত শব্দ শিখিয়েছে- প্রেডিক্টেবল, মেজারেবল, স্কেলেবল; এর বাইরে গেলেই সেটা অবান্তর বা ওয়াস্টেজ হিসেবে গণ্য হবে।

একটা ব্যাটসম্যান ১৫০টা ম্যাচ খেলে ফেললে সেখানে ১০-১২টা ভালো ইনিংস থাকতেই পারে, অন্তত প্রোবাবিলিটি সূত্র থেকে সেটাই সঙ্গত মনে হবে। যে কারণে, পরিসংখ্যানপ্রেমীরা আশরাফুলের ইনিংসগুলোকে অবলীলায় ফ্লুক বা ঝড়ে বক মরা বলতে পারেন। অভিষেক টেস্টেই ১১৪ রানের ইনিংস, বা ইংল্যান্ডের সাথের ৫২ বলে ৯৪ রানের ইনিংস- যে দুটো নিয়ে সবচাইতে বেশি আলোচনা করা হয় আশরাফুলের মহিমা বোঝাতে, সে দুটোকে আমি ফ্লুক মানতে খুবই রাজি। আশরাফুল আরও ১০০ বার চেষ্টা করলেও হয়তোবা ৫২ বলে ৯৪ এর মতো সেই ইনিংসটা খেলতে পারবে না, কিংবা অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরিটাতে যেসব শট ছিলো সেখানে আর্টের চাইতে পিওর হিটিং ফ্যাক্টরই প্রাধান্য পেয়েছে বলবো; বাচ্চা একটা ছেলে মনের আনন্দে খেলে ফেলেছে! এমনকি, সর্বশেষ শ্রীলংকার বিপক্ষে যে ১৯০ করলো, সেটাকেও আমি আশরাফুলীয় বলতে চাইবো না। টেন্ডুলকারের ক্যারিয়ার বেস্ট ২৪৮ যেমন কোনোভাবেই টেন্ডুলকার মাপের নয়, ওই ইনিংসটিও তেমন। আশরাফুলের ব্যাটিংয়ে যে এলিগ্যান্স, তার কিছুই সেখানে ছিলো না; বরং দলে জায়গা নড়বড়ে হয়ে যাওয়া একজন ব্যাটসম্যান ক্যারিয়ার বাঁচাতে দাঁতে দাঁত চেপে সংগ্রাম করছেন, ১৯০কে আমি সেই কাতারেই রাখতে চাই।

কিন্তু টেস্টের সেই ১৫৮? ওটা খেলার জন্য যে অবিশ্বাস্য লেভেলের গড গিফটেড ট্যালেন্ট লাগে, সেটা কীভাবে মেজার বা প্রেডিক্ট করা যাবে?

একটা ছোট্ট তথ্য দিই, আশরাফুলের ১৫৮ রানের সেই ম্যাচটাতে ভারতের পক্ষে দ্রাবিড়, আর গম্ভীর সেঞ্চুরি করেছিলো, বাংলাদেশ টেস্টটা ইনিংস ব্যবধানে হেরেছিলো। তবু ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কারটা পেয়েছিলো সেই ওভাররেটেড আশরাফুল। তখন তার বয়স ছিলো ২০ বছর, এবং কমেন্ট্রিতে বারবার বলা হচ্ছিল ‘he is the best 20 years old batsman in the world’; কিংবা ২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ৮৭ রানের ইনিংস। ইউটিউবে যদি হাইলাইটসও দেখেন, শটগুলো খেয়াল করলে বুঝবেন, কোন্ পর্যায়ের ট্যালেন্ট দরকার হয়, ওরকম ইনিংসের।

আশরাফুল যে অল্প কয়েকটা ম্যাচে বড় স্কোর করেছে, সেই ম্যাচে অপোনেন্ট দলে যত বড় তারকা ব্যাটসম্যানই থাকুক, সে সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি যা-ই করুক, আশরাফুলের পাশে সবকিছু ম্লান হয়ে গেছে, এবং ছন্দে থাকা অবস্থায় কখনোই মনে হয়নি বোলার তাকে আউট করতে পারবে। আশরাফুলের ইনিংস মানে পুরোপুরি মাদকতায় আচ্ছন্ন। ১৫ ম্যাচ পর ১ বার ভালো ইনিংস খেলা দলের জন্য বোঝা হতে পারে, কিন্তু সেই একটা ইনিংসের যে স্পেশালিটি তার কাছে অন্য রেগুলার ইনিংসগুলোর ভ্যালু খুবই সামান্য।

স্পোর্টস যদি কেবলমাত্র এন্টারটেইনমেন্ট হয় সেক্ষেত্রে ১৫ ম্যাচও যদি ওরকম একটা ইনিংস দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আমি রাজি। কিন্তু, স্পোর্টস ন্যাশনালিজমকে প্রোমোট করে। একজন কর্মকর্তা ৫০ লাখ টাকা ঘুষ খেয়েছে, এটা জানার পর আমরা তার প্রতি সাময়িক ঘৃণা বা ক্ষোভ প্রকাশ করি, কিন্তু ২ বলে ৩ রান দরকার, এরকম একটা ম্যাচ হেরে গেলে সেই ব্যাটসম্যানের প্রতি যে পরিমাণ রাগ জমা হয়, তার সাথে ওই ৫০ লাখের তুলনাই হয় না।

বিপরীতক্রমে, একজন মুমূর্ষু রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা কাউকে কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি, কিন্তু শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জিতিয়ে দিয়েছে, সেই ব্যাটসম্যানের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ইচ্ছে করে। স্পোর্টসকে ঘিরে আবেগকে তাই সোস্যাল অন্য কোনো ফেনোমেনা দিয়েই ব্যাখ্যা করা যাবে না। একটা বাউন্ডারি দেখলে যে আনন্দটা হয়, ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার পেলেও হয়তোবা সেটা হবে না। সুতরাং, ১ ম্যাচে ম্যাজিকাল ইনিংস খেলে ১০-১৫ ম্যাচ ফ্লপ করা ব্যাটসম্যানকে দলে রাখাটা বারডেন মনে হতেই পারে। কিন্তু এটাও যদি মাথায় রাখি, ক্রিকেট একটি গভীর সাইকোলজিকাল গেম, সেখানে এরকম একজন প্লেয়ার দলে থাকাটা আবশ্যক। আপনি জানেন ১টা ম্যাচে ম্যাজিক দেখাবে, কিন্তু কোন্ ম্যাচে সেটা জানেন না, ফলে প্রতি ম্যাচেই আশংকা এবং প্রত্যাশা থাকবে, এটাই সেই ম্যাচ নয়তো? প্রতিপক্ষ দলের জন্য এটা কিন্তু বড় একটা সাইকোলজিকাল প্রেসার। আশরাফুল ট্যালেন্টেড কিনা এ নিয়ে তর্ক হতেই পারে, তবে আমার বিবেচনায় সে একজন ট্রু ম্যাজিশিয়ান। রান আর উইকেট তো উছিলামাত্র, cricket is a game of majestic magic!

ট্যালেন্টের সাথে ডেডিকেশন, পরিশ্রম আর ফোকাস লাগে; তারই প্রেক্ষিতে আউটপুট আসে। সমস্যা হলো, আশরাফুলের মধ্যে ফোকাস, আর ডেডিকেশনের মারাত্মক অভাব ছিলো। তার সঙ্গে যোগ করুন, প্রশংসা। আমরা হয়তো বুঝতেই পারি না, প্রশংসা সহ্য করা পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। প্রশংসার প্রাবল্যে অনেকেরই মাথা ঘুরে যায়; আশরাফুল সেই প্রশংসার বাণেই বিদ্ধ হয়ে ডুবে গেছে বলা যায়।

আশরাফুলের ইনিংসের একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো। কোনোভাবে ২০ পার করতে পারলে বা ৩০ টা বল সামাল দিলে সেটাতে এক্সক্লুসিভ ব্যাটিংয়ের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতো। ২৫ থেকে ৪৫, এই রেঞ্জে তার স্কোর খুবই কম। পরিসংখ্যান নিয়ে যাদের খুব আগ্রহ, তারা আরও মেথোডলজিকাল এনালাইসিস করে এই স্টেটমেন্টটা ভেরিফাই করে নিতে পারেন। অর্থাৎ, সমগ্র ক্যারিয়ারজুড়ে সে এই মেন্টাল ব্লকের মধ্যে ছিলো। সে মেডিটেশন কোর্স করেছে, মনোবিদের শরণাপন্ন হয়েছে, কিন্তু এই ব্লক আর কাটাতে পারেনি।

ক্রিকেটের পরিসংখ্যান তার প্রায় ঠোঁটস্থ, কোন্ ম্যাচে কত বল খেলেছে, কত রান করেছে সব মনে রাখতো, অথচ নিজের ব্রেইনের উপরই নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। তার ইংরেজি স্পিকিং নিয়ে অনেক ট্রল হয়েছে, কিন্তু সে যে বাংলাতেও সপ্রতিভভাবে কথা বলতে পারতো না, এটা বোধহয় লক্ষ্য করা হয়নি। আমরা যারা টুকটাক পড়াশোনা করার চেষ্টা করি, ‘প্রডিজি’ শব্দটার সাথে তাদের পরিচয় থাকার কথা। প্রডিজিদের ব্রেইনের ফাংশন সাধারণত খুবই লিনিয়ার হয়, কোনো একটি বিষয়ে তাদের অস্বাভাবিক স্কিলের বিপরীতে বাকি সবকিছুতে স্কিল খুবই নিম্নমানের, যে কারণে তাদের ব্যালান্স রক্ষা করতে হিমশিম খেতে হয়। আশরাফুলকে ক্রিকেট প্রডিজি বলতে আমার একদমই আপত্তি নেই; পরিসংখ্যান যতই শত্রুতা করুক।

কিন্তু আমরা প্রডিজি ব্যাপারটাই ধরতে পারিনি। স্পেশাল ট্যালেন্ট ম্যানেজমেন্টের রীতি-নীতিও স্পেশাল হয়। আমরা সবাইকে একটি ছকে বেঁধে ফেলতে চাই। পৃথিবীতে দুইজন মানুষের ফিঙ্গারপ্রিন্ট যদি এক না হয়, নিয়ম এক হবে কীভাবে। তার মানে কি সবার জন্য পৃথক পৃথক নিয়ম? কখনোই নয়। আপনি যে সেক্টরে কাজ করেন, সেখানে যদি এক্সেপশনালি ট্যালেন্টেড কেউ থাকে, আপনি অবশ্যই তার জন্য আলাদা সিস্টেম করতে বাধ্য; অন্যরা ডিমোটিভেটেড হবে এই যুক্তি বড্ড নড়বড়ে। কেউ ১০০ পাওয়ার যোগ্যতা রাখলে সে ১০০ ই পাবে, ২০ পাওয়া একজন ডিমোটিভেটেড হলে সেটা তার সমস্যা। আশরাফুলকে আমরা ম্যানেজ করতে পারিনি, উল্টো হাবিবুল বাশারকে সরিয়ে তাকে অধিনায়ক করে দিয়েছি।

আশরাফুল, যে কিনা নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, সে কীভাবে একটা দেশের জাতীয় দল পরিচালনা করবে, এই প্রশ্নটি একবারও মাথায় আসেনি, বরং বিশ্বকাপে কয়েকটা ভালো ইনিংস দেখে আর প্রতিভা আছে, এই বিচারে এরকম একজন বোধহীন মানুষকে দিয়ে দেয়া হলো অধিনায়কত্ব। ট্যালেন্ট ম্যানেজ করতে না পারি, ধ্বংস করতে আমরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম।

আশরাফুলের আউটগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করলে তার মাইন্ডসেটের বিবর্তনটা খুব ভালোভাবে বুঝা যায়:

• ২০৪-০৫ পর্যন্ত সে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুল করতে গিয়ে মিসটাইমিং এ টপ এজড হতো। সে সময় তার মধ্যে এগ্রেসিভ ন্যাচার ছিলো প্রবল।

• ২০০৫-২০০৭ এই সময়টাতে সে ড্রাইভ করতে গিয়ে কভারে ক্যাচ দিতো বেশি, কাট করতে গিয়ে পয়েন্টে ধরা পড়তো, বলের লাইন মিস করে বোল্ড হতো, বা আচমকা খেলার ধারার বিপরীতে স্পিন বলে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অন এ ক্যাচ আউট হতো। অর্থাৎ, কনফিডেন্স লেভেল কমে আসছিলো, দলে জায়গা নিয়ে শংকা তৈরি হয়েছিলো, কারণ ততদিনে বেশ কয়েকবার দল থেকে বাদ পড়া হয়ে গেছে। (যদিও বাদ পড়লেই ঘরোয়া লীগে এক্সক্লুসিভ কোনো ইনিংস খেলে আবার কামব্যাক করতো)

• ২০০৭-২০১০ এই সময়ে সে আনঅর্থোডক্স শট খেলতে গিয়ে বেশি আউট হতো। এই সময়ে একবার অধিনায়কত্ব পাওয়ায় নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে আবারো বিশ্বাস তৈরি হয়, যে কারণে নিজেকে আলাদা প্রমাণের জন্য কনভেনশনাল শটের চাইতে আনকনভেনশনাল শটের প্রতিই আস্থা বাড়তে থাকে।

• ২০১০ এর পর থেকে সে নিয়মিত স্লিপে বা কিপারের কাছে কটবিহাইন্ড হতো। এলবিডব্লিউ হওয়ার হারও পূর্বের চাইতে বেড়ে যায়। অর্থাৎ, কনফিডেন্স হারিয়ে, ক্রেজ হারিয়ে সে পুরোপুরি নিঃস্ব মানসিকতার একজন ব্যাটসম্যানে পরিণত হয়।

২-৩টা বাদে আশরাফুলের প্রতিটি ইনিংস দেখেছি, আশরাফুল ব্যাটিংয়ে নামলে উঠতাম না, কখন আউট হয়ে যায় এই ভয়ে। ২০০১ এর জিম্বাবুইয়ে সফরে যখন প্রথমবার সুযোগ পেলো আমি তখন ক্লাশ নাইনে পড়ি; মেট্রো টিমের হয়ে সেঞ্চুরি করেছে, বয়সভিত্তিক দলে খেলছে, সেইসূত্রে আশরাফুলের প্রতি আগে থেকেই আগ্রহ ছিলো। অবশেষে সিরিজের প্রথম ২ ম্যাচ হারার পর ৩য় ম্যাচে ওয়ানডাউনে আশরাফুলকে যখন নামিয়ে দেয়া হলো, অধীর অপেক্ষায় ছিলাম কেমন খেলে ছেলেটা সেটা দেখার জন্য। এন্ডি ব্লিগনট ছিলো বোলার, তাকে ২ টা চার মেরে ৩য় বা ৪র্থ বলে লং অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়েছিলো। ওইটুকু ছোট্ট ইনিংস, কিন্তু শট দুটো দেখার পরই বিমোহিত হই; আল শাহরিয়ার রোকন ছাড়া আর কোনো বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের ব্যাটিং দেখে তো এমন তৃপ্তি পাইনি এর আগে!

তার অভিষেক টেস্টটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করেনি, কিন্তু রেডিওতে পুরো কমেন্ট্রি শুনেছি, পরে টেলিভিশনে হাইলাইটস দেখেছি। এরপর থেকেই আশরাফুলের ব্যাটিং দেখার জন্য বসে থাকতাম। অস্ট্রেলিয়ার সাথে সেঞ্চুরি করলো যে ম্যাচে, পরদিন ইন্টার ফিজিক্স পরীক্ষা ছিলো আমার, তবু আশরাফুলের ব্যাটিং মিস করিনি। সম্ভবত ছেলেবেলার আবেগেই আশায় থাকতাম, প্রত্যেক ম্যাচে আশরাফুল ভালো খেলুক, প্রতি ম্যাচে না হোক, সিরিজে একটা ম্যাচে ভালো খেলুক। সেটাও যখন হলো না, তারপর থেকে আশরাফুলের প্রতি বিরক্তি জন্মাতে থাকলো। কোথায় যেন পড়েছিলাম, অপছন্দ যে কাউকেই করা যায়, কিন্তু ঘৃণা তাকেই করে মানুষ যাকে একসময় প্রচণ্ড ভালোবাসতো। ভালোবাসা আর ঘৃণা পরস্পরের হাত ধরে চলাচল করে। আশরাফুল সমালোচকদের সবচাইতে বড় অংশই একসময় আশরাফুলের ডাই হার্ড ফ্যান ছিলো, কিন্তু দিনের পর দিন প্রত্যাশাভঙ্গের যন্ত্রণায় সেই ভালোবাসা রূপ পেয়েছে বিপুল বিক্ষোভে।

আশরাফুল যখন খেলতো তখন ব্যাটসম্যান হিসেবে ছিলো জাভেদ ওমর, হাবিবুল বাশার, পড়ন্ত বেলার আকরাম-বুলবুল, পরবর্তীতে যুক্ত হয় দুই নাফিস, এবং আরও পরে বোলার থেকে ব্যাটসম্যান হয়ে যাওয়া অলক কাপালী। দুই নাফিসের ট্যালেন্ট ছিলো, কিন্তু সেটা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডের, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডে তাদের ট্যালেন্ট বলতে যে কোনো ক্রীড়া বিশ্লেষকই সেসময় সাহসের অভাবে ভুগতেন। ওইরকম একটা দলে আশরাফুল যখন পারফরম করে ফেলেছে, বা শোয়েব আখতার, ব্রেট লিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসেছে, এটা তার মধ্যে হয়তোবা একধরনের সুপারিওরিটি কমপ্লেক্স তৈরি করেছে, যে কারণে ডেডিকেশন বা ফোকাস তৈরির প্রয়োজনীয়তাই বোধ করেনি। বয়সভিত্তিক দলে সে খেলেছে ওপেনার হিসেবে, জাতীয় দলে তার পারফরম্যান্স সবই ৪ অথবা ৫ নম্বরে।

আমরা আলশাহরিয়ার রোকনের মতো নির্ভেজাল মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানকে জোর করে ওপেনার বানাতে চেয়েছি, জাভেদ ওমরকে খেলিয়ে গিয়েছি, কিন্তু বয়সভিত্তিক দলে ওপেনার হয়ে খেলা একজন ব্যাটসম্যানকে সমগ্র ক্যারিয়ারেই নির্দিষ্ট কোনো পজিশন দিতে পারিনি। টেন্ডুলকার ওয়ানডেতে ওপেন করেছে, টেস্টে ৪ এ ব্যাট করেছে। আশরাফুলও তেমনটা পেতেই পারতো। কিন্তু মুখস্থ নীতিতে সবকিছু একই করা হয়েছে। ওপেন থেকে ৭ নম্বর- সব পজিশনেই ব্যাট করা একমাত্র ব্যাটসম্যান বোধহয় আশরাফুল( অলক কাপালী অবশ্য ৯এও ব্যাটিং করেছে, কিন্তু সে তো দলে এসেছিলো বোলার হিসেবেই)। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে দেয়া ম্যাচের কথা মনে আছে? সেই ম্যাচে সে ব্যাট করেছিলো ৭ নম্বরে, কারণ তার পিঞ্চ হিটিং এবিলিটি কাজে লাগানো হয়েছিলো। কী অদ্ভুত চিন্তা! আশরাফুল খেলছে পিঞ্চ হিটার হিসেবে!

সাকিব, তামিম, মুশফিকরা যখন চলে এলো, সেই দলের অধিনায়ক হওয়া উচিত ছিলো শাহরিয়ার নাফিসের, কিংবা নাফিস ইকবালের। একজন গেল আইসিএল এ, অন্যজন ইনজুরিতে, মাশরাফিও তখন ইনজুরির সাথে নিয়মিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে; তাই কোপটা পড়লো আশরাফুলের ঘাড়েই। অধিনায়কত্ব পাওয়া একজন ক্রিকেটারের জন্য সম্মানের, কিন্তু এটা অনেক বেশি লিডারশিপ আর স্ট্র্যাটেজিক কোয়ালিটির বিষয়, যার বিন্দুমাত্রও আশরাফুলের ছিলো না। বাংলাদেশের সবচাইতে অজনপ্রিয় অধিনায়ক কে, এটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। পুরনো ইতিহাস ঘাঁটাঘাটি করলেই দেখবেন, আশরাফুলের মতো এতোটা গণরোষের মুখে কোনো অধিনায়ককে পদ হারাতে হয়নি।

আশরাফুল হটাও, বারবার কেন আশরাফুল, আর কত সুযোগ পেলে আশরাফুল নিজেকে প্রমাণ করতে পারবে- এরকম অজস্র প্রতিবাদমুখর কর্মকাণ্ড তখন অনলাইন ব্লগগুলোতে চোখে পড়তো; আশরাফুলের সাথে বোর্ড প্রেসিডেন্টের বিশেষ খাতির, আশরাফুল সাংবাদিকদের টাকা খাইয়ে বশ করে রেখেছে- এরকম কত কনস্পাইরেসি থিওরি তখন ছড়িয়ে পড়েছিলো। ২০১১ বিশ্বকাপে আয়ার‌ল্যান্ড বিশ্বকাপে উইকেট পাওয়ার পর উদযাপনের ভঙ্গি নিয়ে ‘পোলা তো নয় যেন আগুনের গোলা’ ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করে ভাইরাল করা হয়েছিলো।

বাংলাদেশে সবচাইতে ভালোবাসা পাওয়া ক্রিকেটার আশরাফুল (২০১৫-২০১৬ এর মাশরাফি ফ্যাক্টর বাদে), সবচাইতে নিন্দিত ক্রিকেটারও সে। আশরাফুলের ব্যাটিংয়ের সময় কত মানুষ হাত তুলে দোয়া করেছে, সেটা ২০০৫-০৬ এর ম্যাচের স্মৃতিগুলো মনে করার চেষ্টা করলেই পাবেন।

ফিক্সিং ইস্যু নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। আন্তর্জাতিক ম্যাচে তার ফিক্সিংয়ের অভিযোগ পাওয়া গেলেও সেগুলো প্রমাণিত হয়েছে কিনা জানি না, সম্ভবত বিপিএল এর ফিক্সিং কেলেংকারিতেই সে শাস্তি পেয়েছে। স্পোর্টস এর সাথে গভীর সেন্টিমেন্ট জড়িত, তাই স্পোর্টস এর পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে তাকে শাস্তি দেয়া অবশ্যই যৌক্তিক।

অলিম্পিকি তো ডোপ টেস্ট পজিটিভ হলে পদকও কেড়ে নেয়া হয়, স্পোর্টসের জন্য এটা দরকার। একটা বাউন্ডারির দাম কয়েক কোটি টাকা, সুতরাং সেখানে দুর্নীতি করলে তার ক্ষমা হয় না। কিন্তু অবাক লাগে যখন দেখি আশরাফুল দোষ স্বীকার করেছে বলে তাকে মহান বানানোর চেষ্টা করা হয়, আবারো জাতীয় দলে দেখতে চাওয়ার আশা করা হয়। আশরাফুলের সাথে আমার পরিচয় মাঠসূত্রে, সেগুলোর রেকর্ড ইউটিউবে আছে, সুতরাং ফিক্সার আশরাফুলকে আমার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু যেই মানুষগুলো আশরাফুলকে নিয়ে এতো প্রতিবাদ করতো, কেন বাদ পড়ছে না এ নিয়ে বিলাপ করতো, তারাই এখন আশরাফুল বন্দনায় মেতে উঠেছে। সমগ্র ক্যারিয়ারে আশরাফুল যতটা প্রশংসা পেয়েছে, ফিক্সিংয়ের পর যেন প্রশংসা কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। বড় অদ্ভুত মানসিকতা, Mob psychology ঠাহর করবে সাধ্য কার! আশরাফুল বাঙালি প্রবঞ্চক মানসিকতার এক সার্থক কেস স্টাডি!

ভবিষ্যতে বাংলাদেশের যদি সর্বকালের সেরা একাদশ গঠন করা হয়, সেখানে আশরাফুলের থাকার সম্ভাবনা খুবই কম, কিন্তু আমি মনে করি আশরাফুল এমন এক ব্যাটসম্যান যার জন্য এইসব প্যারামিটার কেবলই কথা আর পাণ্ডিত্যের ফুলছড়ি।

আরও ৩১ বছর সুস্থভাবে বাঁচলে ক্রিকেটের অনেকগুলো ইনিংসই দেখা হবে আশা করি, কিন্তু চোখ বুজলে ১৫৮ ছাড়া অন্যকিছু কি আদৌ আসতে পারবে? পরিসংখ্যান পটুয়াখালিতে যাক, কনভারসন যাক কক্সবাজারে; ম্যাজিশিয়ানের খোঁজ করলেই ১৫৮ কে টেনে আনবো।

আমার কাছে হিরো কখনোই সারাজীবন হিরো নয়, ভিলেনও সারাজীবন ভিলেন নয়। কিন্তু আশরাফুল মানে আশরাফুলই। হায় আশরাফুল!-খেলাধুলা
১২ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪ডটকম/এপি/ডিপি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে