শুক্রবার, ০৬ মে, ২০২২, ১১:৪৬:৩২

এক প্যাকেট বিস্কুটের টাকা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন কার্তিক!

এক প্যাকেট বিস্কুটের টাকা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন কার্তিক!

স্পোর্টস ডেস্ক: এটি কোন গল্প নয়, এক ক্রিকেটারের বাস্তব জীবনের কাহিনী। বাঁহাতি সবকিছু! মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অভিষিক্ত স্পিনার কুমার কার্তিককে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় এমনটাই বলছিলেন ধারাভাষ্যকাররা। তারা মোটেও ভুল কিছু বলেননি। কেননা অভিষেকেই রিস্ট স্পিন, রং ওয়ান, ফিঙ্গার স্পিন, এমনকি ক্যারম বলও করেছেন কুমার কার্তিক।

টানা আট ম্যাচ হারা মুম্বাইয়ের পক্ষে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে নবম ম্যাচে অভিষেক হয়েছে কার্তিকের। এই ম্যাচে প্রথম জয়ের দেখা পেয়েছে মুম্বাই। যেখানে নিজের প্রথম ওভারেই রাজস্থান অধিনায়ক সাঞ্জু স্যামনসকে ফেরান কার্তিক। সবমিলিয়ে ৪ ওভারে খরচ করেন মাত্র ১৯ রান।

অথচ ছয় মাস আগেও একজন সাধারণ বাঁহাতি অর্থোডক্স স্পিনার ছিলেন কার্তিক। তার কোচ সঞ্জয় ভার্দওয়াজ জানিয়েছেন, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সফল হওয়ার জন্য রিস্ট স্পিন শিখেছেন কার্তিক। যা কি না ক্রিকেটের অন্যতম কঠিন স্কিল। সেটি রপ্ত করে নিজের স্কিল অনেক বাড়িয়ে নিয়েছেন কার্তিক।

আর এ সবকিছুই হয়েছে নয় বছর আগে ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের ক্রিকেটের প্রতি অশেষ ভালোবাসা ও টানের কারণে। পুরোপুরি একার চেষ্টায় কানপুর থেকে দিল্লিতে ভার্দওয়াজের অ্যাকাডেমিতে চলে আসেন কার্তিক। পরিবারকে বলে আসেন, ক্রিকেটের কারণে কনস্টেবল বাবার ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবেন না তিনি।

দিল্লিতে বন্ধু রাঁধে শ্যাম ছাড়া আর কাউকে চিনতেন না কিশোর বয়সের কার্তিক। রাঁধে শ্যাম নিজেও খেলতে লিগ ক্রিকেটে। তার মাধ্যমেই দিল্লির নানান অ্যাকাডেমিতে ঘুরে বেড়ান কার্তিক। কিন্তু সব জায়গায়ই মোটা অঙ্কের ফি চাওয়া হয়।

শেষমেশ তারা ভার্দওয়াজের অ্যাকাডেমিতে যায় এবং শুরুতেই বলে দেয় কোচিংয়ের ফি দেওয়ার মতো অবস্থা নেই কার্তিকের। এ কথা শোনার পরেও ট্রায়াল নিতে রাজি হন ভার্দওয়াজ এবং কার্তিকের একটি ডেলিভারি দেখেই তাকে অ্যাকাডেমিতে রাখতে সম্মত হন বর্ষীয়ান কোচ।

কার্তিককে প্রথম দেখার স্মৃতি জানিয়ে ভার্দওয়াজ বলেছেন, ‘কার্তিকের অ্যাকশন ছিল খুবই স্মুদ ও সুন্দর। বলের ওপর ওর আঙুলের ব্যবহার অ্যাকশনকে আরও নিখুঁত করছিল।’

ভার্দওয়াজের কল্যাণে কোচিংয়ের ব্যবস্থা হলেও থাকা-খাওয়ার জন্য সংগ্রামে নামতে হয় কার্তিককে। নিজের ভরণপোষণের জন্য ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে মাসুরি নামক গ্রামের একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ নেন কার্তিক। সেখানেই হয় থাকার ব্যবস্থা।

সারারাত ফ্যাক্টরিতে কাজ করে দিনের বেলা অ্যাকাডেমিতে অনুশীলন করতে যেতেন কার্তিক। প্রায় সময়ই এক প্যাকেট বিস্কুটের টাকা বাঁচাতে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতেন তিনি।

ভার্দওয়াজ যখন এই অবস্থার কথা জানতে পারেন, তখন তিনি নিজের ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেন, কাছে কোথাও কেনো থাকেন না কার্তিক? তখন কার্তিক নিজের কোচকে ফ্যাক্টরিতে রাতের কাজের কথা জানান। এটি শুনে অ্যাকাডেমির বাবুর্চির সঙ্গে কার্তিকের থাকার ব্যবস্থা করে দেন ভার্দওয়াজ।

 নতুন ঠিকানায় কার্তিকের প্রথম দিনের কথা এখনও মনে আছে ভার্দওয়াজের, ‘যখন অ্যাকাডেমির বাবুর্চি ওকে (কার্তিক) দুপুরের খাবার দিলো, তখন ও কান্না শুরু করে দিলো! কারণ প্রায় এক বছর দুপুরে কিছু খায়নি।’

এরপর কার্তিককে একটি স্কুলে ভর্তি করে দেন ভার্দওয়াজ। যার ফলে স্কুলের বিভিন্ন টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পান কার্তিক এবং ডিডিসিএ লিগে ৪৫ উইকেট নেন। দিল্লির সম্মানজনক ওম নাথ সুদ টুর্নামেন্টসহ তিনটি টুর্নামেন্টে আসর সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন কার্তিক।

তবু যখন ডিডিসিএ ট্রায়ালে যান, তখন ২০০ জনের তালিকায়ও জায়গা করে নিতে পারেননি কার্তিক। তাই পুরোনো এক পথ বেছে নেন ভারতের দুই তারকা গৌতম গম্ভীর ও অমিত মিশ্রদের কোচ ভার্দওয়াজ। দিল্লিতে তুমুল প্রতিযোগিতার মাঝে অমিত মিশ্র যখন সুবিধা করতে পারছিলেন না, তখন তাকে হরিয়ানায় পাঠান ভার্দওয়াজ।

আর এবার কার্তিককে তিনি পাঠান মধ্য প্রদেশে। এ বিষয়ে ভার্দওয়াজ বলেন, ‘কার্তিকের সামর্থ্য ও ডেডিকেশন দেখে আমি ওকে আমার বন্ধু ও শাহদল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি অজয় দিবেদির কাছে পাঠিয়ে দেই। সেখানে ডিভিশন ক্রিকেট খেলে দুই বছর ৫০ উইকেট নেয় কার্তিক।’

পরে মধ্য প্রদেশের ট্রায়াল ম্যাচগুলোতে প্রতি ম্যাচেই ৫টি করে উইকেট নেন এ বাঁহাতি রহস্য স্পিনার। যে কারণে মধ্য প্রদেশের হয়ে বয়সভিত্তিক কোনো দলে না খেলেই সরাসরি রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হয়ে যায় কার্তিকের। ২০১৮ সালে রঞ্জি অভিষেকের পরই প্রথমবারের মতো কার্তিকের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন ভার্দওয়াজ।

এরপর থেকে কার্তিকের নতুন বাড়ি হয়ে যায় ভোপালে ভার্দওয়াজের নতুন অ্যাকাডেমি। যেখানে থাকারও সুব্যবস্থা ছিল। সেই অ্যাকডেমিতেই পুরো দমে ক্রিকেট অনুশীলন শুরু হয় কার্তিকের। এই অ্যাকাডেমিতেই একাগ্রতার সঙ্গে রিস্ট স্পিন শিখেছেন কার্তিক।

আইপিএল অভিষেকে এতোটাই নিখুঁত রিস্ট স্পিন করেছেন কার্তিক, যা দেখে নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরিও অবাক হয়েছেন। কারণ একদমই কোনো আলগা ডেলিভারি দেননি কার্তিক। যা দেখে বাকিরা বিস্মিত হলেও ভার্দওয়াজের কাছে এটি নতুন কিছু নয়।

তাই তো তিনি বলেছেন, ‘কার্তিক যখনই অবসর সময় পায়, নেটে বোলিং শুরু করে দেয়। প্রায় সময়ই দেখা যেতো ইন্দোর থেকে ম্যাচ খেলে বেশ দেরিতে ফিরেছে। তখনও লাইট জ্বালিয়ে পরের দুই-তিন ঘণ্টা নেটে বোলিং অনুশীলন করতো। গত নয় বছরের ক্রিকেটের প্রতি ওর টানা শুধু বেড়েই চলেছে।’

এতো বাধা পার করে আইপিএল মঞ্চে পা রেখে প্রথম ওভারেই সাঞ্জু স্যামসনের উইকেট নিয়েছেন কার্তিক। নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক তারকা ব্যাটারের নাম যোগ হবে কার্তিকের শিকারের তালিকায়। যদি সেটি নাও হয়, তবু দমে যাবেন না কার্তিক। কেননা এ পর্যন্ত আসতে অনেক কিছুই দেখেছেন ২৪ বছর বয়সী এ স্পিনার।-ইএসপিএন ক্রিকইনফো

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে