জাহিদ হাসান ও রুদ্র মিজান : চাঞ্চল্যকর তনু হত্যাকাণ্ডের নয় দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত হত্যারহস্য উদঘাটন হয়নি। দৃশ্যমান হয়নি তদন্তের অগ্রগতি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, হত্যার ক্লু উদঘাটন করতে নানা বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। ফের ময়না তদন্তের জন্য আজ তনুর লাশ উত্তোলন করা হচ্ছে।
এদিকে গতকালও তনু হত্যার বিচার দাবিতে সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সড়ক অবরোধ হয়েছে রাজধানীতে। একই দাবিতে আজ গণজাগরণ মঞ্চের ডাকে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক ঘণ্টার ধর্মঘট পালিত হবে। আগামী ৩রা এপ্রিল সর্বাত্মক ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে।
এদিকে গতকাল দুপুরে ডিবি ও সিআইডির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কথা বলেছেন নিহতের পরিবারের সঙ্গে। তার আগে সকালে র্যাবের একটি দল তনুর বাসায় গিয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সন্দেহভাজন কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ডিবি। তাদের মধ্যে তনুর কয়েকজন বন্ধু ও সেনানিবাস এলাকার বাসিন্দা রয়েছেন। সূত্রমতে, তনুর পরিবারের সন্দেহের ভিত্তিতে পিয়ালকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পিয়াল জানিয়েছেন, এ ঘটনার পর অন্যদের মতোই চলাফেরা কমিয়ে দেন তিনি। এই হত্যাকাণ্ড কারা, কেন ঘটিয়েছে এ বিষয়েও কোনো ধারণা নেই তার। তবে পিয়াল নিজেও জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তি দাবি করেছেন। জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি স্বীকার করে ডিবির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মঞ্জুর আলম বলেন, এ বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে পিয়ালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। নিহতের স্বজনরা সন্দেহ করলেও এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনায় কে বা কারা জড়িত থাকতে পারে সে বিষয়ে এখনো কোনো ক্লু উদঘাটন সম্ভব হয়নি বলে জানান ডিবির ওসি। নিহত সোহাগী জাহান তনু ও তার চাচাতো বোন লাইজু জাহান সমবয়সী। ছোটবেলা থেকেই তনুদের বাসায় থাকেন তিনি। তার বোন ও ভালো বান্ধবী লাইজু। গতকাল কথা হয়েছে তার সঙ্গে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের এই ছাত্রী জানান, সেনানিবাসসহ ক্যাম্পাসে সবার প্রিয় ছিল তনু। সেনানিবাসের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানেই থাকতো তার অংশগ্রহণ। পথচলার সময় ডানেবামে তাকাতো না। সেই তনুকেই এভাবে হত্যা করা হলো। তিনি জানান, পিয়াল ছাড়া কেউ কখনও তাকে উত্ত্যক্ত করেছিল বলে জানা নেই।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লাইজু জানান, অজানা কারণেই মনটা বেশ খারাপ ছিল তনুর মা আনোয়ারা বেগমের। মেঝেতে বসেছিলেন তিনি। হঠাৎ দেয়াল ঘড়িতে চোখ পড়তেই নড়েচড়ে উঠেন। রাত প্রায় সাড়ে ৮টা। টিউশনির জন্য সাড়ে ৩টায় বাসা থেকে বের হয়েছিল তনু। সাড়ে ৭টার মধ্যে ফেরার কথা। কিন্তু তখনও ফিরেনি। ফোনে কল দিয়ে পাচ্ছিলেন না। লাইজুকে নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি। সেনানিবাসের টুকিটাকি ক্যান্টিন পর্যন্ত খুঁজেও তনুর দেখা পাননি। ডায়াবেটিসের রোগী আনোয়ারা বেগম ক্লান্ত হয়ে অলিপুরের কালভার্টে বসেছিলেন কিছুক্ষণ। যে কালভার্টের পাশেই পাওয়া গিয়েছিল তনুর লাশ।
মা আনোয়ারার বরাত দিয়ে তনুর বড় ভাই নাজমুল হোসেন জানান, কিন্তু তখন সেখানে কোনো শব্দ পাননি তিনি। ততক্ষণে তনুর মেজ ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল সাইকেল নিয়ে খুঁজতে বের হন। ১০টার পর বাসায় পৌঁছে পিতা ইয়ার হোসেন ও প্রতিবেশী শিক্ষক শিকদার কামাল তনুকে খুঁজতে বের হন। বাসা থেকে ১০০ গজ দূরে কালো ট্যাংকের নিচে টর্চের আলোতে তনুর স্যান্ডেল দেখে বুকটা ধক করে ওঠে ইয়ার হোসেনের। সেখানে পাহাড়ের ঢালে পড়ে আছে তার মোবাইল ফোনের ব্যাগ। তখনও তনুর দুটি ফোনের মধ্যে একটিতে কল ঢুকছিলো। কিন্তু রিসিভ হয় না। সেই ফোনটি পাওয়া গেছে জঙ্গলে। পাশের ঝোপে পড়ে আছে অন্য মোবাইলফোনের কভার। পড়ে আছে ব্যাটারি। সেখানেই নিথর, রক্তাক্ত তনুকে পাওয়া গেছে। ইয়ার হোসেনের কান্না শুনে অন্যরা ছুটে এসেছিলেন।
এ বিষয়ে ফোনে তনুর পিতা ইয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বলেন, নাজমুল সব জানে। তার কাছে শুনুন। আমি অসুস্থ। কথা বলতে পারছি না। এ বিষয়ে নাজমুল জানান, তনুর মাথার পেছনে আঘাত ছিল। হিজাব ও ওড়না তার দেহের পাশে খোলা অবস্থায় ছিল। তার নাকে, কানে রক্ত ছিল। সালোয়ার, কামিজ পরনে থাকলেও কামিজের নিচে একটু ছেড়া ছিল বলে জানান তিনি।
তনুর লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন করেন কোতয়ালি মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইফুল ইসলাম। সুরতহালে এসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তিনি। সাইফুল ইসলাম জানান, সোহাগী জাহান তনুর মাথার পেছনে আঘাত ছিল। তার মৃতদেহের পাশে মোবাইলফোন, টর্চ, পাওয়া গেছে। মুখে রক্ত, বাম কানের উপরের মুখের বাম পাশে সামান্য চামড়া ছিলানো, পরনের কামিজ সামান্য ছেড়া ছিল বলে জানান তিনি। এছাড়া শরীরের কোথাও কোনো ক্ষত বা আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ঘটনার পরদিন সকালে কুমিল্লা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে তনুর লাশ গ্রহণ করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে পুলিশ।
গতকাল দুপুরে কুমিল্লার পুলিশ সুপার শাহ মো. আবিদ হোসেন, সিআইডির পুলিশ সুপার নাজমুল কবিরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তার আগে পরে কয়েকবার মামলার তদন্ত কার্যক্রম নিয়ে বৈঠক করেন তারা। আজ তনুদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের মির্জাপুরের কবরস্থান থেকে তার লাশ উত্তোলন করা হবে। লাশ উত্তোলনের পুরো প্রক্রিয়া তদারকি করবেন কুমিল্লা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বেগম লুৎফুন্নাহার ও মুরাদনগরের এসিল্যান্ড আলী আজগর।
২০শে মার্চ তনু হত্যাকাণ্ডের পর এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন তার পিতা ইয়ার হোসেন। ২৫শে মার্চ মামলার গুরুত্ব বিবেচনা করে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়। সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়ে। এ বিষয়ে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক জানান, আমরা মামলার কিছু কাগজপত্র পেয়েছি। বাকি নথিপত্র আজকের মধ্যে হস্তান্তর হতে পারে। -এমজমিন
৩০ মার্চ, ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস