জাহিদ হাসান ও রুদ্র মিজান : তনু হত্যার ঘটনায় আবারও পিয়াল ওরফে পিআরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সেনানিবাস এলাকায় তনুকে ওই যুবক উত্ত্যক্ত করতো বলে অভিযোগ উঠেছে। তার আগে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছিল। গতকাল দীর্ঘ সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।
নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ঘাটন করতে গতকাল সেনানিবাস এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিআইডি, ডিবি ও পিআইবি’র তদন্তকারী দল। এসময় পিয়াল ওরফে পিআর নামে ওই যুবককে সেনানিবাস থেকে সিআইডি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় দেড় ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তাকে আবার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিআইডি।
বোর্ডে রাত ৯টা পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন মামলার তদন্ত সহায়ক দলের প্রধান সিআইডির সিনিয়র পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দের নেতৃত্বাধীন টিমের কর্মকর্তারা। এছাড়াও পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিআইবি) গতকাল সকালে তনুর মা, বাবা, ভাই ও চাচাতো বোনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এদিকে, ভিসেরা পরীক্ষার আংশিক রিপোর্ট পেয়েছে সিআইডি।
সূত্রমতে, ওই রিপোর্ট অনুসারে তনুকে হত্যার আগে বিষপান করানোর কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এদিকে চাঞ্চল্যকর তনু হত্যাকাণ্ডের বিচার হবে কি-না এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার পিতা ইয়ার হোসেন ও বড়ভাই নাজমুল হোসেন। তারা মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই হত্যার বিচার হবে না।
গতকাল সকালে কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকার ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে পৃথকভাবে দীর্ঘ এক ঘণ্টা কথা বলেন তারা। এসময় তনু হত্যার বিচার চেয়ে ইয়ার হোসেন বলেন, হত্যাকাণ্ডের ১০-১২ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে কিছুই হয়নি। কোনো ক্লু বের হয়নি। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক। তার হস্তক্ষেপ ছাড়া সম্ভব না।
তিনি বলেন, আমি কম লেখাপড়া করছি। এতো বুঝি না। আপনারা জ্ঞানী, শিক্ষিত মানুষ। মেয়ে তো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে মরে নাই। কুমিল্লা শহরে মরে নাই। ভেতরে মরছে। আমি কারও নাম বলি না। কারা মেরেছে আমি জানি না। আল্লাহ দেখছে। আপনারা বিবেককে প্রশ্ন করুন। আপনারা বুঝেন না বিষয়টা! তনু আর ফিরে আসবে না। আমি বিচার চাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাই।
তনুর ভাই নাজমুল জানান, তার বোনকে কেউ উত্ত্যক্ত করতো এটা জানতেন না তারা। তবে চাচাতো বোন লাইজুর কাছে প্রায় দেড়-দু’মাস আগে তনু জানিয়েছিলেন পিয়াল তাকে উত্ত্যক্ত করে। হত্যাকাণ্ডের পর পর ডিবি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলো।
এ বিষয়ে ডিবি’র কুমিল্লার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঞ্জুর আলম জানান, তাকে প্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তদন্তের স্বার্থে আবার তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পিয়াল আড্ডা দিতেন তনুদের বাসার পাশে কালভার্টে। সেনানিবাসেই থাকেন পিয়াল।
তনুর পিতা ইয়ার হোসেন বলেন, তনু ছিলো চাপা স্বভাবের, কারও কাছে কিছু বলতো না। বিশেষ কাজ ছাড়া কারও বাসায় বেড়াতে যেতো না। ক্যান্টনমেন্টেই বড় হয়েছে। ক্যান্টনমেন্ট ছিলো তনুর নিজের বাড়ির মতো, নিরাপদ এলাকা। এই এলাকায় কখনও আমার মেয়ে অনিরাপদ তা কল্পনাও করিনি। সে ভিক্টোরিয়ায় লেখাপড়া করতো। বাইরে যেতে হতো। দুশ্চিন্তা করতাম বাইরে কোনো সমস্যা হয় কি-না।
তিনি বলেন, তনু সেনাকল্যাণে কম্পিউটার শিখেছে। নাচ, গান ও নৃত্য শিখেছে স্কুল থেকেই। সেনানিবাসে অনুষ্ঠান হলে তাতে অংশগ্রহণ করতো। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হতো।
তনুর লাশ উদ্ধার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে ওই স্থানে দেখা তিন যুবক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিন যুবক দ্রুত কালভার্ট এলাকার সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলো। ডিবি বা সিআইডি কেউ শনাক্ত করতে পারেনি তাদের।
হত্যাকাণ্ডের দিন টিউশনি করতে যাওয়ার সময় মা আনোয়ারাকে সঙ্গে যেতে না করেন তনু। ২৬শে মার্চ কলেজের অনুষ্ঠানে নতুন কাপড় পরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। বাবার কেনা কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করতে দিয়েছিলো সেনানিবাস এলাকায় এক নারী টেইলার্সের কাছে। ইয়ার হোসেন জানান, তনু বলেছিলো, মা তোমাকে আমার সঙ্গে আজ যেতে হবে না। আমার জামাটা নিয়ে এসো।
ইয়ার হোসেন বলেন, ওই দিন স্থানীয় এমপির হাত থেকে নৃত্যের জন্য পুরস্কার নেয়ার কথা ছিলো তার। এ জন্য তনু বলেছিলো, বাবা আমি পুরস্কার পাবো। আমার সঙ্গে কে যাবে তুমি, নাকি আম্মা। মেয়ের আনন্দে খুশি হয়ে ইয়ার হোসেন বলেছিলেন, তোর মাকে নিয়ে যা। তোর মা দেখুক তুই পুরস্কার পাচ্ছিস। সেই পুরস্কার নেয়া হয়নি তনুর। পরা হয়নি সেই নতুন জামা।
এদিকে, গতকাল বিকালে ভিসেরা রিপোর্ট পেয়েছেন সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তা ও মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। ভিসেরা রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিষপানের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কামদা প্রসাদ সাহা ভিসেরা রিপোর্ট পাওয়ার সত্যতা স্বীকার করেন।-এমজমিন
৪ এপ্রিল ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস