সোমবার, ০৪ জুলাই, ২০১৬, ০৩:৩৯:৫১

ঘরের লক্ষ্মী নাই কিয়ের ঈদ : তনুর মা

ঘরের লক্ষ্মী নাই কিয়ের ঈদ : তনুর মা

মাসুক আলতাফ চৌধুরী: কুমিল্লায় নিহত কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর পরিবারের সদস্যরা এখন শুধুই কাঁদেন। উচ্ছল-প্রাণবন্ত মেয়েটির কথা উঠতেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন মা আনোয়ারা বেগম। আসন্ন ঈদ নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত, তখন তার বাবা ইয়ার হোসেন নামাজের পাটিতে বসে কান্নাকেই অবলম্বন করেছেন। মা-বাবার এ অবস্থা দেখে কান্না চেপে রাখতে পারেন না তনুর বড় ভাই আনোয়ার হোসেনও। তনু নেই- তাই ঈদ ঘিরে কোনো আনন্দ আয়োজনও নেই। হয়নি কেনাকাটাও। ১০-১২ বছর কুমিল্লা সেনানিবাসের কোয়ার্টারে ঈদ করলেও এবার সবাই যাবেন মুরাদনগর উপজেলার মির্জাপুরে গ্রামের বাড়িতে। কারণ সেখানেই আছে তনুর কবর।


সম্প্রতি কোয়ার্টারে গিয়ে তনুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা হয়। মা আনোয়ারা বেগম বলেন, 'আমার লাইগ্যা ঈদ শুভ না, কষ্টের। মাইয়্যা নাই কেমন যে লাগে, কইতে পারি না।' কথাগুলো বলতে বলতেই দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কিছুটা সামলে নিয়ে তিনি আবার বলেন, 'মেয়ে তো শেষ, আমিও শেষ। ভেতরটা মানে না। আমি কারাগারে বন্দি। সব অশান্তি লাগে। গতবার মাইয়্যা ছিল, ঈদ করছি বাসায়। এবার বাড়িত যামুগা। ওহানেই ঈদে থাকমু। ঘরের লক্ষ্মী নাই। আমার কিয়ের ঈদ।' বিগত ঈদের দিনের স্মৃতি হাতড়িয়ে তিনি জানান, কোনো কোনো ঈদের দিন দুপুরের পর বাসায় আবারও রান্না চড়াতে হতো। তখন তনু বলত, 'মা, আমরার বাসার সব খানা শেষ হইয়া যায় তাড়াতাড়ি। সবাই আসতে চায়। খাওয়া-দাওয়া করে। অন্যরার বাসারটি থাইক্যা যায়।' এবার কে এমন কথা বলবে- এমন প্রশ্ন করে আবারও দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কান্না শুরু করেন আনোয়ারা বেগম।


তনুর এক খালা, এক চাচা। তাদের মধ্যে বিয়ে হওয়ার সুবাদে পরিবারটি একান্নবর্তী। গ্রামের বাড়িতেই জন্ম হয় তনুর। এরপর দুই বছর বয়সেই কুমিল্লা সেনানিবাসের কোয়ার্টারে চলে আসে। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ১৯। কথা ও কান্নার মাঝে হঠাৎ প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন তনুর মা। তিনি বলেন, বড় ছেলে নাজমুল তনুর মৃত্যুর পর থেকে কোয়ার্টারে আসতে ভয় পায়। কিসের ভয়- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এক সময় আমাদের সব মোবাইল ফোন রেকর্ড হতো। ঘটনার পর থেকে আমরা নানা ধরনের নজরদারিতে আছি। তাই নাজমুল কোয়ার্টারে আসে না। গ্রামের বাড়িতে ঈদ করার পেছনে এটিও একটি বড় কারণ। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'তিন মাস ১০ দিন হইল। কেইসটা ডাউন দিয়া দিল। বাসা থিক্যা হাসতে হাসতে বাইর হইল মাইয়াড্যা, লাশ হইয়া জঙ্গলে পইড়া রইল'- এ কথাগুলো বলেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।


পাশে থাকা আনোয়ার হোসেন রুবেল জানালেন, আশপাশের কোয়ার্টারের বাসিন্দারা ঈদের দিন তাদের বাসাতেই খাওয়া-দাওয়া করতেন। দুই ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন তনু সবাইকে নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে থাকতেন। সে বাসায় ৮-১০ পদের রান্না করতেন। হালিম, পুডিং, চটপটি, কেক, পুলি পিঠা, কেক পিঠা, ফিনি্ন, পোলাও, মাংস এসব রান্না নিয়ে ঈদের ২-৩ দিন আগে থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন তনু। ঈদের দিন ছোট-বড় সবাই ভিড় করত। তনু ছিল সবার মধ্যমণি। ১০ থেকে ১২ বছর ধরে এভাবেই কেটেছে তাদের ঈদ। এরপর 'এবার' শব্দটি উচ্চারণ করেই কথা থামিয়ে দেন রুবেল। তখন তার দু'চোখে শুধুই অশ্রু। বলেন, 'বড় ভাই নাজমুল হোসেন ঢাকা থেকে টাকা পাঠালেই রোজার শেষের দিকে শুরু হতো ঈদের কেনাকাটা, বাবাও টাকা দিতেন। মায়ের কাপড়, বাবা এমনকি আমার কাপড়ও পছন্দ করে দিত তনুই। কিন্তু এবার কিছুই কেনা হয়নি।'

তনুর বাবা ইয়ার হোসেন জানান, বড় ছেলে নাজমুল ঢাকা থেকে সরাসরি গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। ঈদের দু'দিন আগে তারাও গ্রামে যাবেন। গ্রামেই তনুর কবর। 'কবরই আমার ঈদ, আমার সব'- বলে কেঁদে ওঠেন তনুর বাবা। তিনি জানান, তনুর দাদা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। রোজা শুরুর আগেই তাকে সেনানিবাসের কোয়ার্টারে নিয়ে আসা হতো। কোরবানির ঈদের পর একবারে বাড়ি যেতেন। এবার তাকে আনা হয়নি। গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই কোয়ার্টারেই ঈদ করা হতো। এবার বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। 'বাড়িত আলো লাগছে, আমার ঘরের আলো নিভাইয়া দিছে। আব্বা এবার বাড়িত, অসুস্থ। বাড়িতেই যামু'- বলেন ইয়ার হোসেন।-সমকাল

৪ জুলাই ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে