নারায়ণগঞ্জ : নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ৭ খুনের মামলায় চার্জশিটে থাকা ৩৫ আসামির মধ্যে ২৬ জনের ফাঁসি ও বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন আদালত। সোমবার সকালে নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন এ রায় ঘোষণা করেন। এরপরই আবারও আলোচনায় উঠে আসে কীভাবে তাদের হত্যা করা হয়।
আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে চাকরিচ্যুত র্যাব কর্মকর্তা লে. কর্নেল তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও নৌ-বাহিনীর লে. কমান্ডার এমএম রানা জানান, অপহৃত ৭ জনকে মাইক্রোবাসের ভেতরে ইনজেকশন পুশ করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। পরে লাশ ফেলে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে।
জবানবন্দিতে এমএম রানা বলেন, ২০১৪ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ নিজেই মেজর আরিফকে 'সন্ত্রাসী' নজরুলের একটি প্রোফাইল দেখিয়ে বলে তাকে গ্রেফতার এবং এজন্য আরিফকে সহায়তায় আমাকে নির্দেশ দেন। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল আনুমানিক ১টার দিকে মেজর আরিফের নিকট ফোন আসে যে, নজরুল ২টি গাড়ি নিয়ে কোর্ট থেকে বের হচ্ছে। নজরুলের গাড়ি দুটি বের হওয়ার পর আমরা আমাদের মাইক্রোবাস ২টি নিয়ে ওই গাড়ি ২টিকে ফলো করি এবং পেট্রোল টিমকে গাড়ি ২টির বর্ণনা দিয়ে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পর সিটি কর্পোরেশনের গেটের নিকট ফাঁকা জায়গায় থামাতে বলি।
তিনি জানান, আনুমানিক ১টা ২০ মিনিটের দিকে পেট্রোল টিম নজরুলের গাড়ি ২টিকে সিটি কর্পোরেশনের গেটের মুখে থামায়, তখন আমাদের ২টি মাইক্রোবাসে থাকা সিভিল টিম নজরুলের গাড়ি ২টি থেকে সকল লোককে গ্রেফতার করে আমাদের মাইক্রোবাস ২টিতে তোলে। আমি মাইক্রোবাস থেকে নেমে ঘটনাস্থলে পেট্রোল টিমের সঙ্গে থেকে যাই এবং মেজর আরিফ মাইক্রোবাস ২টিতে ধৃত লোকদের নিয়ে চিটাগাংরোডের দিকে চলে যায়। আমি সিদ্ধিরগঞ্জ হতে সিএনজি করে আদমজীনগর ব্যাটালিয়ন সদরে ফিরে অধিনায়কের অফিস কক্ষে অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করি এবং অধিনায়ককে অপারেশন বিষয়ে অবহিত করে জানাই যে, নজরুলসহ ৫/৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রানা আরও জানান, নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে পৌঁছে আনুমানিক ৫টার দিকে আমি সিওকে ফোন করে জানাই যে, নজরুলসহ ধৃতদের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট রয়েছেন। অনুমান ৫টা ১০ মিনিটের দিকে মেজর আরিফ আমাকে ফোন করলে জিজ্ঞাসা করি মোট কতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তখন সে বলে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন আমি বলি যে, ওই ৭ জনের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট আছে, তুমি অপারেশন কমান্ডার তাই তার সম্পর্কে বুঝে শুনে সিও স্যারকে সাজেশন দিও। অনুমান রাত ১টার দিকে মেজর আরিফের অধীনে থাকা মাইক্রোবাসসহ সিভিল টিমটি ক্যাম্পে পৌঁছানোর বিষয়ে রিপোর্ট করে। রাত অনুমান ১ টা ৩৫ মিনিটের দিকে এডিজি (ওপস) কর্নেল জিয়া আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, আরিফ .........। তখন আমি বলি স্যার আমি আরিফ না, রানা, আরিফের নম্বর শেষে ডবল ফাইভ। তারপর স্যার ফোন রেখে দেন। পরের দিন ২৮ এপ্রিল আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার সময় মেজর আরিফের সঙ্গে আমার সামনাসামনি কথা হলে, সে বলে স্যার, কর্নেল জিয়া গতকাল রাত ৩টায় আমাকে ডেকেছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন যে, নজরুলদের কেন মারছ? কিভাবে মারছ? তখন আমি বলেছি, আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করছেন? সিও স্যারকে জিজ্ঞাসা করেন। আমি যা করেছি সিও স্যারের নির্দেশে করেছি। ওই সময় মেজর আরিফ আরো বলেন যে, আমি রাত সাড়ে ১২টার সময় এক্সিকিউশন করেছি ইনজেকশন পুশ করে কাচপুর ব্রিজের নিচে গাড়ির ভিতরে শ্বাসরোধ করে।
এদিকে, ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে তারেক সাঈদ বলেন, ঘটনার দিন মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার নজরুল আজকে আদালতে আসবে, তাকে আজ গ্রেফতার করা যাবে। তখন আমি নজরুলকে গ্রেফতারের জন্য আরিফকে অনুমতি দেই। এরপর আনুমানিক দুপুর ২টার সময় মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে টার্গেট নজরুলের সঙ্গে ৪ জন থাকার কথা জানায়।
১৭ এপ্রিল রাত ৮টা। আমি নজরুলের স্ত্রী ও শ্বশুরের জন্য আমার অফিসে অপেক্ষা করছিলাম। তখন মেজর আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার আমার লোক বদলি করতে হবে, আপনি একটা গাড়ি দেন। আমি আরিফকে নরসিংদীর ক্যাম্পে বিশ্রাম নিয়ে একবারেই নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরতে বলি। রাত ৮টার পর থেকে রাত ৯টার আগ পর্যন্ত আমি নজরুলের স্ত্রী, শ্বশুর ও নজরুলের আরো ১০/১২ জন লোকের সঙ্গে মিটিং করি। ওই সময় নজরুলের শ্বশুর ও স্ত্রী বলেন, নূর হোসেন নজরুলকে অপহরণ করেছে। নূর হোসেনকে গ্রেফতার করলেই নজরুলকে পাওয়া যাবে। রাত ৯টার দিকে আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার রাস্তায় পুলিশের কড়া চেকিং চলছে। আমি সিভিল গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ আসলে চেকিংয়ে পড়বো। তাই আমার ক্যাম্পে ফেরার জন্য নৌকা দরকার। তখন আমি আরিফকে বলি, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রানার সঙ্গে কথা বলে তুমি সব ঠিক করে নাও। এরপর আমি রানা আর আরিফের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে সমন্বয় করে নিতে বলি। রাত সোয়া ১১টায় আরিফ আমাকে ফোন করে বলেন, স্যার, আমি কাঁচপুর পৌঁছে গেছি। তখন আমি বলি, ঠিক আছে। রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমি নৌকা ঘাটে পৌঁছাই। আমি পৌঁছানোর ২০/২৫ মিনিট পর মেজর আরিফও নৌকা ঘাটে পৌঁছান।
হত্যার নির্দেশ দেয়নি দাবি করে তারেক সাঈদ দাবি করেন, এরপর আমি আরিফকে তার লোকজনসহ আসামিদের নিয়ে গাড়িতে উঠাতে বলি এবং র্যাব হেডকোয়ার্টারে যেতে বলি। তখন আরিফ বলেন, স্যার, আসামিদের মেরে ফেলেছি। তখন আমি আরিফকে বলি, মেরে ফেলেছো, মানে! কেন মেরেছো? আরিফ বলেন, নজরুল আমাকে চিনে ফেলেছে, তাই আমি নজরুলকে মেরেছি। অন্যরা দেখে ফেলেছে, তাই ভয়ে তাদেরকেও মেরে ফেলেছি। আরিফ জানায়, সে মোট সাতজনকে মেরেছে। তখন আমি বলি, সাতজন মানে? তুমি তো গ্রেফতার করেছো ৫ জনের, এখনও আরও দু'জন কোথায় থেকে এলো?
আরিফ আমাকে বলেন, স্যার, আমার গাড়িতে ৫ জন ছিল। ওই পাঁচজনের বিষয়ে আমি আপনাকে রিপোর্ট দিয়েছি। পেছনে আর একটি গাড়ি থেকে রানা স্যার দু’জনকে পাঠিয়েছেন। এই দু’জনের বিষয়ে আপনাকে জানানো হয়নি। ভেবেছিলাম ক্যাম্পে এসে জানাবো। এই কথা শুনে আমি আরিফের সৈনিকদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি। তখন আমি নিচে নেমে সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে তাদের আশ্বস্ত করি যে কোনো সমস্যা নাই।
১৬ জানুয়ারী, ২০১৭এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম