জাকির হোসেন লিটন: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সরকার দলীয় এমপি শামীম ওসমানের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় তোলপাড় চলছে। কিছুদিন বিরতির পর সরকারদলীয় প্রভাবশালী এ দুই নেতার প্রকাশ্য সংঘর্ষে চরম বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে আওয়ামী লীগ।
সরকারের শেষ সময়ে এসে রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষে ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল। তাদের দু’জনকেই ফোন করে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ইতোমধ্যেই ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে আইভী ও শামীমকে।
এ ঘটনা দলের ইমেজ নষ্ট করেছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ঘটনার তদন্ত চলছে। যারা জনসম্মুখে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পার্টির ইমেজ নষ্ট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ফুটপাথ থেকে হকার উচ্ছেদ ও বসানোকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমানের সমর্থকদের সংঘর্ষে রণেেত্র পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া। সংঘর্ষে মেয়র আইভী, স্থানীয় সাংবাদিক ও মতাসীন দলের শতাধিক নেতাকর্মী ও সমর্থক আহত হন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তেেপ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘটনার জন্য আইভী ও শামীম ওসমান একে অপরকে দায়ী করে উত্তপ্ত বক্তব্য দেন।
একটি মার্কেটে বসে শামীম ওসমান নিজেই এ হামলা পরিচালনা করেন বলে তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগ করেন মেয়র আইভী। অন্য দিকে শামীম ওসমান এ ঘটনায় আইভীকে দায়ী করে তাকে মোকাবেলায় তিনি একাই যথেষ্ট বলে হুঁশিয়ার করে দেন।
গতকাল বুধবারও বাকযুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন শামীম ও আইভী। দু’জনই আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে আবারো একে অপরকে দায়ী করেন। দুপুরে সিটি করপোরেশনের কাজ শেষ করে সাংবাদিকদের ডাকেন আইভী। অন্য দিকে বেলা সাড়ে ৩টায় নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস কাবে সংবাদ সম্মেলন করেন শামীম।
আইভীর অভিযোগ, ‘শামীম ওসমানের নির্দেশে তাকে হত্যার জন্য হামলা হয়েছে।’ অন্য দিকে শামীম বলেছেন, ‘যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটা আইভী বনাম শামীম ওসমান নয়। এটা হকার বনাম আইভীর বিষয়।’
এ দিকে আইভী ও শামীমের সাথে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি জানিয়েছেন, দু’জনকেই ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জে আইভী-শামীমের সমর্থকদের সংঘর্ষে দেশজুড়ে বেশ তোলপাড় চলছে। গতকাল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ ছিল নারায়ণগঞ্জের ঘটনা। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সরকারদলীয় নেতাদের প্রকাশ্য অস্ত্র ও আইভী রহমান রাস্তায় পড়ে থাকার দৃশ্য। অনেকেই ফেসবুকে শেয়ার করেন শামীম ওসমানের উত্তেজিত বক্তব্য। হাজার হাজার কমেন্টস পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী ও সরকারকে কটাক্ষ করে। ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের এমন ঘটনা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে।
ফলে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই পরিবারের পূর্ববিরোধ আবারো এমনভাবে প্রকাশ্য সংঘর্ষে রূপ নেয়ায় চরম বিপাকে পড়েছে ক্ষমতাসীন দল। আগামী নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এমন ঘটনা দলের ইমেজ নষ্ট করেছে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতি নির্ধারকেরা।
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বিষয়টি সম্পর্কে গতকাল সচিবালয়ে বলেছেন, ‘হাত থাকতে মুখে কি- দু’জনের দ্বন্দ্ব এই পর্যায়ে যাবে তা কারোরই বিবেচনায় ছিল না।’
আওয়ামী লীগের এই জনপ্রতিনিধিদের ডেকে প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইভী ও শামীম মুখোমুখি হওয়ার পর পরিস্থিতি বোঝা গেছে। বিষয়টি আপনাদের কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত, আমার কাছেও অপ্রত্যাশিত।’
এই দুইজনের দ্বন্দ্ব অনেক দিনের জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘কালকে (মঙ্গলবার) যে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে চলে যাবে এটা তো বুঝি নাই। বুঝলে আমরা ইন্টারভেন করতাম, আমরা বুঝিইনি জিনিসটা। দুইজনই আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধি, আমাদের দলেরই। বন্ধু-বান্ধবীর মধ্যে মারামারি হবে; কিন্তু এটা একটু বেশি মাত্রায় হয়ে গেছে। এখন এটা যদি সরকারের ইন্টারভেনশন দরকার লাগে অবশ্যই আমরা ইন্টারভেন করব। যদিও মনে হয় বিষয়টি একেবারেই ব্যক্তিগত। তবুও আমরা রিপোর্ট চাচ্ছি কী হয়েছে।
যদি পয়েন্ট অব কনফিক্ট থাকে সেটা আমরা অবশ্যই মীমাংসা করব, অবশ্যই এরমধ্যে আমরা ইনভলব হবো। আমরা অলরেডি ডিসি-এসপির কাছে রিপোর্ট চেয়েছি।’
আইভী-শামীমের দ্বন্দ্ব থেকে সংঘর্ষের ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে আর চুপ থাকার সুযোগ নেই মন্তব্য করে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী আরো বলেন, ‘বিষয়টা এখন আর মুখ ঘুরিয়ে রাখার বিষয় না, বিষয়টা রাস্তায় এসে গেছে। শুধু রাস্তায়ই আসেনি, ইটপাটকেলের মধ্যে চলে আসছে।’
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত ওসমান ও চুনকা পরিবারের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘ দিনের। বিএনপির ভোট বর্জনের মধ্যে ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটির প্রথম নির্বাচনে শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে মেয়র হয়েছিলেন আইভী। তখন আওয়ামী লীগ কাউকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন না দিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা শামীমের পইে প্রচার চালিয়েছিলেন। দলে বিরুদ্ধ স্রোতের মধ্যেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে নামা আইভী ভোটে বিজয়ী হন। যদিও শামীমের দাবি, বিএনপির ভোট আইভীকে জয়ী হতে সহায়তা করে।
ভোটের পর ত্বকী হত্যাকাণ্ড এবং ৭ খুন নিয়ে আইভী ও শামীমের দ্বন্দ্ব চরমে ওঠে। প্রকাশ্য সভায় একে অন্যের প্রতি বিষোদগারের পাশাপাশি টেলিভিশন বিতর্কে তাদের মারমুখী ভূমিকায়ও দেখা যায়। ২০১৬ সালের সিটি নির্বাচনে আইভী ও শামীম দুইজনই দলের টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে ব্যক্তিগত ইমেজের কারণে আইভীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয় আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে শামীম ওসমানের আইভীবিরোধী অবস্থান দলের হাইকমান্ড ভালোভাবে নেয়নি। পরে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দুইজনকে গণভবনে ডেকে পাঠান। বৈঠকে শেখ হাসিনার সামনেও তারা ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। পরে দুইজনকেই সতর্ক করে শামীমকে আইভীর পক্ষে কাজ করার নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনার সামনেই শামীম ওসমান আইভীকে ‘ছোট বোন’ বলে সম্বোধন করেন। ওই বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
ওই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী আইভী মেয়র হিসেবে বিজয়ী হলেও দুইজনের দ্বন্দ্ব থেকেই যায়। বিভিন্ন সভা সমাবেশে দুইজনই পরস্পরের সমালোচনায় মুখর হন। সর্বশেষ ফুটপাথে হকার বসা নিয়ে দুই দিকে অবস্থান নেন আইভী-শামীম। মেয়র হিসেবে সুন্দর শহর গড়ার প্রত্যয়ে আইভী হকার উচ্ছেদের পক্ষে। অন্য দিকে এমপি হিসেবে শামীম হকারদের পক্ষে। গত ডিসেম্বরে উচ্ছেদ করা হকারদের ফিরিয়ে আনার দাবিতে সোচ্চার শামীম। সোমবার তার বেঁধে দেয়া ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শেষে মঙ্গলবার শহরে দুই নেতার অনুসারীদের মধ্যে হয় ব্যাপক সংঘর্ষ। এ সময় গোলাগুলিও হয়।
এমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন দলের নারায়ণগঞ্জের দুই জনপ্রতিনিধিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে কঠোর বার্তা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমানকে ফোন দিয়ে শান্ত থাকতে বলেছেন।
সচিবালয়ে নিজ দফতরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে পার্টির সেক্রেটারি ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন ম্যাসেজটা তাদের কাছে পৌঁছে দেন- তারা (আইভী-শামীম) যাতে শান্ত থাকে। পরস্পরবিরোধী অ্যাকটিভিটিসে যাতে না যায়। এ ম্যাসেজটাই আমি পৌঁছে দিয়েছি। বলেছি যে তারা যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন এবং শান্তি রার জন্য যাতে প্রশাসনকে সহযোগিতা করেন।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডিস্থ রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাকে যখন নারায়ণগঞ্জের পুলিশের এসপি ঘটনা জানান, তখন আমি দুইজনকেই (সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান) ফোন করে বলেছি অনভিপ্রেত ঘটনা স্টপ করতে। দুই পকেই ডাকবো এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগ বড় দল। এখানে সমস্যা তো মাঝে মধ্যে হয়। তাদের এ সমস্যা সিটি করপোরেশনের শান্তিপূর্ণ পরিবেশও নষ্ট করেনি আমাদের বিজয়েও বাধা হয়নি, ভোট ব্যাংকেরও তি হয়নি। তবে যে ঘটনা ঘটেছে তা অনভিপ্রেত এবং অনাকাক্সিক্ষত। দলের অভ্যন্তরীণ কলহ জনসম্মুখে আসা খুবই খারাপ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের ঘটনার তদন্ত চলছে। যারা জনসম্মুখে ভায়োলেন্সের মাধ্যমে পার্টির ইমেজ নষ্ট করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।’
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস