রাজশাহী: সারি করে রাখা চারটি কফিন। চারজন করে শিক্ষার্থী সেগুলো ধরে কাঁধে নিলেন। এগোতে শুরু করলেন। তাঁদের পেছনে হাঁটা শুরু করলেন শতাধিক শিক্ষার্থী। তাঁদের মুখে প্রতিবাদী স্লোগান—‘চুপ করে থাকলে, খুন হবে এভাবে’, ‘আমার স্যার মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই’।
গত এক যুগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষককে খুনের প্রতিবাদে চারটি কফিন নিয়ে গতকাল সোমবার এই প্রতীকী কফিন মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ খুন হওয়া অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে হত্যার প্রতিবাদ এবং দোষীদের বিচারের দাবিতে এদিন এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে ‘মুকুল প্রতিবাদ ও সংহতি মঞ্চ’ (অধ্যাপক রেজাউল করিম মুকুল নামে পরিচিত ছিলেন) থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় শুরু হয় প্রতীকী কফিন মিছিলটি। সিনেট ভবনের সামনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির অবস্থান ধর্মঘটস্থলে গিয়ে এটি শেষ হয়। দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সেখানে অবস্থান ধর্মঘট পালন করেন শিক্ষকেরা।
অবস্থান ধর্মঘটে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আজ আমাদের সামনে এখানে চারটি কফিন রাখা হয়েছে প্রতীকী হিসেবে। কফিনগুলো আমাদের চারজন শিক্ষকের নৃশংস খুনের চিত্র তুলে ধরছে। এর মাধ্যমে আমরা দেশবাসীকে দেখাতে চাই, দেখুন, আমাদের ক্ষত এখনো শুকায়নি। আমরা আর কোনো সহকর্মীর কফিন দেখতে চাই না। কিন্তু এই লাশ শেষ লাশ, এই কফিন শেষ কফিন হবে তো?’
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহ আজম বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নেতাদের অংশগ্রহণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মহাসমাবেশ হবে। সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে প্রদীপ জ্বালানো হবে। বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় শহীদুল্লাহ কলাভবনের সামনে থেকে শোক শোভাযাত্রা বের করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। সেটি ‘মুকুল প্রতিবাদ ও সংহতি মঞ্চ’-এ গিয়ে সমাবেশ করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটিতেও আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন অধ্যাপক মো. শহীদুল্লাহ। সমাবেশে অধ্যাপক রেজাউলের মেয়ে রিজওয়ানা হাসিন শতভি বলেন, ‘সরকার যেন এ ঘটনার দায় সারানোর চেষ্টা না করে সে জন্য সজাগ থাকতে হবে। বাবাকে যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।’
এই অবস্থান ধর্মঘট ছাড়াও কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকেরা। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসূচি: শিক্ষকদের কর্মবিরতি, কালো ব্যাজ ধারণ ও অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এ ছাড়া অধ্যাপক রেজাউল করিমের স্মরণে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোববার থেকে সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হয়েছে। বুধবার শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও ওই দিন সন্ধ্যায় শিববাড়ি মোড় থেকে শহীদ হাদীস পার্ক পর্যন্ত আলোর মিছিল বের করা হবে।
ছাড়া পেলেন বাবা-ছেলে: অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার ঘটনায় রাজশাহীর বাগমারা থেকে আটক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আবদুল হাকিম ও তাঁর ছেলে আরিফুল হককে গতকাল ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। পাঁচ দিন ধরে রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে আটকে রেখে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এদিকে গত ২৩ এপ্রিল রাতে আটক হওয়া রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও রাজশাহী নগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ড ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি হাফিজুর রহমানকে চার দিনের রিমান্ড শেষে রোববার তাঁকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডের কোনো সূত্র পাওয়া গেছে কি না জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রাজশাহী মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ পরিদর্শক রেজাউস সাদিক বলেন, বলার মতো সে রকম কিছু পেলে তাঁরা সবাইকে জানাবেন।
হাফিজুরকে আটকের পরের দিন বাগমারার দরগামাড়িয়া গ্রামের মসজিদের ইমাম রায়হান আলী ও মতিহার থানার ললিতাহার এলাকার যুবক খায়রুল ইসলামকে পুলিশ আটক করেছিল। গতকাল দুপুরে রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে রাজশাহী মহানগর হাকিম আদালত-১-এর বিচারক মোকসেদা আজগর তাঁদের চার দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত ২৩ এপ্রিল সকাল সাড়ে সাতটার দিকে নগরের শালবাগান এলাকায় নিজ বাসার সামনে শিক্ষক রেজাউলকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার তাঁর ছেলে রিয়াসাত ইমতিয়াজ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।-প্রথম আলো
৩ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ