মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:০৯:২৯

বিএনপির সেই সুরক্ষিত ঘাঁটি এখন অরক্ষিত

রেজাউল করিম রাজু : দু’দশকের বেশি সময় ধরে থাকা বিএনপির সুরক্ষিত রাজশাহী ঘাঁটি এখন অরক্ষিত। কি ক্ষমতায়, কি ক্ষমতার বাইরে- সব সময় এখানকার সংসদীয় আসনগুলো প্রায় সবই ছিল তাদের। এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে কাউকে ধানের শীষ প্রতীক ধরিয়ে দিলেই নির্বাচনী বৈতরণী পার। গর্ব করে বলা হতো রাজশাহীর অঞ্চলের মাটি বিএনপির দুর্জয় ঘাঁটি। শহীদ প্রসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের পক্ষে রায় দিয়েছে জনতা। মন্ত্রী, এমপি, মেয়র সব কিছুতেই ছিল জয় জয়কার।

বিশেষ করে এরশাদ সরকারের পতনের পর থেকে প্রচন্ড প্রতাপের সঙ্গে চলেছে সবকিছুই। মাঝখানে একবার আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এলেও এ অঞ্চলের ভোটের হাওয়া বদলায়নি। ২০০৭ সালে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের শাসনামলে বয়ে যাওয়া রাজনৈতিক সিডরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় বিএনপির। মন্ত্রী ও মেয়রদের যেতে হয় জেলে। এমপিদের অনেকে হন দেশান্তরী। নেতারা চলে যান আত্মগোপনে। এ সময় নির্বাচনে খানিকটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। এরপর শুরু হয় আওয়ামী শাসনামল। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া রোর্ডমার্চ ও জনসভার কর্মসূচি দিয়ে বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের জাগিয়ে তোলেন। তার কর্মসূচিতে জনজোয়ার দেখা যায়।

ঝিমিয়েপড়া বিএনপিতে প্রাণ ফিরে আসে। আবারও ঘুরে দাঁড়ায়। নির্বাচনে আগে ঘরের ও বাইরের ষড়যন্ত্র আর আওয়ামী রাজনৈতিক আইলা ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ফের মুখ থুবড়ে পড়ে। এত কিছুর মাঝেও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন, উপজেলা, পৌরসভা, ইউপি নির্বাচনগুলোয় মানুষ বিএনপি জোটের পক্ষে রায় দেয়। যার বিরুপ প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক রকমের। বিএনপি জোটকে ধ্বংস করে দেবার জন্য নির্যাতনের স্টিম রোলার চলে। রাস্তায় বের হলেই হতে হয় হামলা মামলার শিকার। রাজপথে বেশ কিছু প্রাণও যায়। সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও জোরদার হয়। মিছিল বের হলেই চলে গুলি।

মিছিলকারীরা ইটপাটকেল, ককটেল ফাটিয়ে তাদের কর্মসূচি পালন করে। পুলিশ ভ্যানে বোমা হামলায় সিদ্ধার্থ নামে এক পুলিশ কনেস্টেবল নিহত হবার পর শুরু হয় নেতাকর্মীদের নামে মামলার প্রতিযোগিতা। অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে গাড়ি ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ আর পেট্রোলবোমা হামলা মামলায় নেতাদের নামের সাথে শত শত অজ্ঞাতনামা বলে মামলা দিয়ে শুরু হয় গ্রেফতার আর রিমান্ড বাণিজ্য। জেলে যায় শত শত কর্মী। ঘর ছাড়ে হাজার হাজার। প্রায় প্রত্যেক মামলায় নেতাদের করা হয় হুকুমের আসামি।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনুসহ নেতারা উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের পড়ে মামলার মুখে। অবশেষে তারা চলে যায় আত্মগোপনে। নাশকতার মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে বিপুল ভোটে নির্বাচিত রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে পুলিশের সুপারিশে মন্ত্রণালয় সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। শুধু বুলবুল নয় কর্পোরেশনের অধিকাংশ বিএনপিপন্থী কাউন্সিলরদের নামে দেয়া হয় অনেক মামলা। কোনো মামলা না থাকার পরও প্যানেল মেয়র-৩ নুরুন্নাহার ভারপ্রাপ্ত মেয়র হতে চেয়ে চিঠি দেবার পর তার বিরুদ্ধে দেয়া হয় নাশকতার মামলা। এখন তার অবস্থা মেয়র পদ চাই না মামলা ঠেকাও। উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রদের অবস্থা একই।

অনেককেই একই কারণ দেখিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে। চেয়ারম্যানের পদ কেড়েছে। উচ্চ আদালত থেকে কেউ কেউ জামিন নিয়ে এলেও পদ ফিরে পায়নি। তারা ব্যস্ত মামলার হাজিরা দিতে। অনেক কর্মী বছরের বেশি সময় ধরে আটক রয়েছে কারাগারে। মাঝ পর্যায়ের অনেক নেতাকর্মীর ব্যবসা-বাণিজ্য, পরিবার-পরিজন হয়ে পড়েছে ছিন্নভিন্ন। নিদারুণ কষ্টে কাটছে তাদের দিনকাল। মামলা চালাতে সহায়-সম্বল শেষ। উপরের নেতাদের অবস্থা ভালো থাকলেও তার পরের কেউ কারো খোঁজ রাখে না। দল ক্ষমতায় থাকার সুবাদে সুবিধাবাদী গ্রুপ যারা গাছের উপরের ও তলার খেয়ে জিরো থেকে হিরো হওয়াদের খবর নেই। তারা রয়েছেন অর্জিত সম্পদ নিরাপদ রাখতে। অনেকে গোপনে হাত মিলিয়েছেন সরকারি দলের প্রভাবশালীদের সাথে। কোনো মামলার আচড় লাগেনি।

এক সময় যারা নিজেদের দলের নীতিনির্ধারক বলে গলাবাজি করত। ফুটপাত থেকে কোটিপতি বনেছে এখন তাদের খবর নেই। কেউ কেউ দল করে এমন পরিচয় দিতে লজ্জা করে। দলের মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বলেন, কিছু কিছু নেতার অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত আর প্রতারণার কারণে আজ আন্দোলন সফল হয়নি। এরা কর্মসূচির নামে হাজার হাজার কর্মীকে মাঠে নামালেও তা ছিল প্রদর্শনীর মতো। রাজপথের আন্দোলনে সক্রিয় হবার রাশ টেনে রেখেছে। তাতে লাভ কি হয়েছে। বোমাবাজি, গাড়ি ভাংচুর কিংবা পেট্রোলবোমা না মেরেও এসবের মামলার আসামি হতে হয়েছে।

এর চেয়ে রাজপথে সক্রিয় হলে ফলাফল ভিন্ন হতে পারত। আন্দোলনে হতাশ হয়ে মহিলা দলের কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে ঘুপচি মেরে থাকা নেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ওদের হাতে চুরি পরিয়ে দাও। কে বা কারা মেয়েদের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসের ছবিসংবলিত ডিজিটাল ব্যানার দলের অফিসের সামনে টানিয়ে দিয়েছিল। এবারো ঈদের আনন্দ নিরানন্দভাবে কেটেছে কর্মীদের। ঈদের তিন দিন আগে মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে কারাগারে গেছেন যুগ্ম মহাসচিব মিজানুর রহমান মিনু। আর সরিয়ে দেয়া মেয়র বুলবুল রয়েছেন আড়ালে। কারাগারে আটক ও মামলা মাথায় নিয়ে ফেরারি জীবন যাপনকারী কর্মী ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়, আমাদের স্বজনদের কেউ খোঁজখবর নেয় না। শুনেছি মামলার ও জেলখানার খরচের জন্য চাঁদা উঠেছে। কিন্তু কোনো সহায়তা মেলেনি।

দলের অনেক আইনজীবী আছেন কোর্টে গেলে তারা চেনেন না, এমন ভাব করেন। মামলা চালাতে না পারার কারণে অনেকের জামিন আটকে আছে। একই ধরনের মামলায় জোটের শরিক জামায়াতের নেতাকর্মীরা আইনি ও পারিবারিকভাবে সহায়তা পেলেও বিএনপির বেলায় তেমনটি দেখা যায় না। বিএনপির খুব সহসা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই দেখে সুবিধাভোগী চক্র এখন অনেক অনেক দূরে। ফলে আর্থিক সহায়তাও মেলে না। বিএনপির উপর দিয়ে এত রাজনৈতিক সিডর নির্যাতন, মামলা-হামলার ঝড় বয়ে গেলেও নেতাদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ কোন্দল এখনো বহাল রয়েছে। গত রমজানে দেখা যায়, রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. কামরুল মনির নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে তার অনুসারীদের নিয়ে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেন।

পর দিন জেলা বিএনপি সভাপতি অ্যাড নাদিম মোস্তফা আরেকটি কমিউনিটি সেন্টারে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেন। দলের এ দুঃসময়ে এমন পাল্টাপাল্টি ইফতার আয়োজনে কর্মী-সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। বিধ্বস্ত বিএনপিকে ফের পুনর্গঠনের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়েছে নির্যাতিত নেতাকর্মীরা। প্রতারণাকারী আর কোনো কোনো মীরজাফরের কারণে দলের এমন বেহাল দশা তা খতিয়ে দেখে তাদের যেন সরিয়ে দেয়া হয়। আর পকেট থেকে বের হওয়া কমিটি নয়। সঠিক নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা পেলে বিএনপি ফের ঘুরে দাঁড়াবে এমন প্রত্যাশা তাদের। কারণ জনসমর্থন এখনো তাদের পক্ষেই আছে।-ইনকিলাব
৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/হাবিব/একে
 
 

 

 
 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে