ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : নির্বাচনী চালে হতবাক চঞ্চলা। দারুণ মর্মাহতও। তাকে নিয়ে যেন রীতিমতো দাবার চাল চালানো হচ্ছে। এ কারণে সবাই আছে ফুরফুরে মেজাজে। আর চঞ্চলাকে লড়াই করতে হচ্ছে অদৃশ্য ছায়ার সঙ্গে। ওই ছায়াকে তিনি না পারছেন ধরতে, না পারছেন ছুঁইতে।
দাঁড় করাতে পারছেন না কোনো শক্তিশালী প্রমাণও। এরপরও ভোটের মাঠে প্রতিবাদী চঞ্চলা দাশ। যতই বাধা আসছে ততই যেন তার মনোবল আরও শক্ত হচ্ছে। চঞ্চলা দাশ নিজে লন্ডন প্রবাসী। স্বামী শ্রীপদ দাস লন্ডন প্রবাসী। স্বামী সম্পত্তি, পিতৃ সম্পত্তি আছে অঢেল। ব্যাংকেও তার কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা। কিন্তু হলফনামার তথ্য অনুযায়ী তার কিছুই নেই। তার হলফনামা নিয়েও ঝড় উঠেছে ভোটের মাঠে।
নানা কথা বলাবলি হচ্ছে তাকে নিয়ে। আর এতে করে চঞ্চলা কখনো হচ্ছেন বিক্ষুব্ধ, আবার কখনো ভোটের লড়াইয়ের কথা চিন্তা করে শান্ত হওয়ার ‘ভান’ করছেন। এমনটি হবে- চিন্তা করতে পারছেন না চঞ্চলা দাস। তিনি ভাবছেন এক আর ঘটছে তার ঠিক উল্টো। লন্ডন প্রবাসী চঞ্চলা দাস সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। তার পিতার বাড়ি সুনামগঞ্জের টাইয়া গ্রামে।
স্বামীর বাড়ি মৌলভীবাজারের বড়লেখার বাঘিরপাড় গ্রামে। তবে, তিনি দিরাই উপজেলার লুলারচরে নিজের বাড়ি নির্মাণ করছেন। জেলা পরিষদ নির্বাচনে সুনামগঞ্জে এবার চেয়ারম্যানপ্রার্থী নিয়ে তোলপাড় চলছে। আওয়ামী লীগ থেকে প্রার্থী দেয়া হয়েছে ব্যারিস্ট্রার এনামুল কবির ইমনকে। আর তার বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে সরব রয়েছেন সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুট। এই দুজনের ভিড়ে এসে প্রার্থী হয়েছেন চঞ্চলা দাস।
রাজনৈতিকভাবে চঞ্চলা দাস আওয়ামী কর্মজীবী লীগের সহ-মহিলা বিষয়ক সম্পাদক। বিশাল বিষয়-সম্পত্তি, টাকাপয়সা থাকার পরও নির্বাচনী হলফনামায় চঞ্চলাকে নেহাত গরিব ও ভূমিহীন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হলফনামায় রয়েছে বেসরকারি চাকরিজীবী। এ নারী চেয়ারম্যান প্রার্থীর অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিজের নগদ ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আছে ৩ লাখ টাকা। ২ লাখ টাকা মূল্যের ৫ ভরি স্বর্ণালঙ্কার, এক লাখ টাকার ইলেকট্রিক সামগ্রী, সমপরিমাণ টাকার আসবাবপত্র এবং স্বামীর নামে রয়েছে ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রিক সামগ্রী। সিলেট বিভাগের একমাত্র এই নারী চেয়ারম্যান প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ। হলফনামায় তিনি তার বার্ষিক আয়ের একমাত্র উৎস দেখিয়েছেন সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত অর্থ।
নির্বাচনে অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাব্য খাতে উল্লেখ করেছেন, বেসরকারি চাকরি থেকে ১ লাখ টাকা, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত দান হিসেবে প্রবাসী স্বামী শ্রীপদ দাসের ২ লাখ টাকা। এই হলফনামা নিয়ে ঘোর আপত্তি চঞ্চলার। জানালেন নেপথ্য কাহিনী। বললেন, একটি মহল আমার সঙ্গে ছায়ার মতো দুষমনী করছে। এ কারণে তার এই হলফনামায় এ তথ্য দেয়া হয়েছে। আর হলফনামাটিও নির্বাচন কর্মকর্তারা গ্রহণ করে তাকে বৈধ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
চঞ্চলা জানান, মনোনয়নপত্র তিনি নিজে পূরণ করেননি। টাকার বিনিময়ে সাহায্য নেন সুনামগঞ্জ নির্বাচনী কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মচারী শহীদুল্লাহ মিশু, রুহুল আমীন ও সায়েমের। টাকার বিনিময়ে তারা তার মনোনয়নপত্রের ফরম পূরণ করে দেয়। এ সময় চঞ্চলা যা বলেছেন- তারা লিখে দিয়েছে তার ঠিক উল্টো। এ সময় তাকে দিয়ে আরও একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়। পূরণের একপর্যায়ে ওই তিন কর্মচারী চঞ্চলাকে জানান তার ফরম নষ্ট হয়ে গেছে। তাকে আরও ৮১ হাজার টাকা দিয়ে নতুন ফরম কিনতে হবে। পরে তারা ৫০ হাজার টাকায় নতুন ফরম দিয়ে দেবে বলেও জানান। কিন্তু চঞ্চলা তাদের সে প্রস্তাব মানেননি।
একপর্যায়ে তিনি বড় কর্তাদের দ্বারস্থ হলে তাকে বিনা পয়সায় নতুন ফরম দেয়া হয়। চঞ্চলা দাবি করেন, তার প্রতিদ্বন্দ্বী একজন প্রভাবশালী চেয়ারম্যান প্রার্থীর ইন্ধনে এমনটি করা হয়েছে। তিনি বিষয়টি সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবগত করেছেন। ন্যাশনাল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংকসহ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে চঞ্চলার অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে তার দেড় থেকে দুই কোটি টাকা। অথচ হলফনামায় তাকে নেহাত গরিব সাজিয়ে টাকার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
চঞ্চলার নিজের রয়েছে শতাধিক ভরি স্বর্ণালঙ্কার। বড়লেখায় স্বামীর নামে রয়েছে বিশাল সম্পত্তি। তিনি ভূমিহীন নয়। অথচ হলফনামায় তাকে ভূমিহীন সাজানো হয়েছে। পরবর্তীকালে প্রার্থীদের ইন্ধনেই তার হলফনামা মিডিয়ায় চাউর করা হয়েছে। প্রার্থিতা বৈধ হওয়ার পর চঞ্চলা পড়েছেন নতুন করে বেকায়দায়।
তিনি বলেন, প্রার্থী হওয়ার আগে আমি ঢাকার জিগাতলাস্থ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাসায় যাই। তার আর্শীবাদ নিই। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আর্শীবাদ দিয়েছেন। তিনি পৌর মেয়র মোশারফ মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা প্রদীপকে নির্দেশ দিয়েছিলেন আমাকে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু দিরাইয়ে এসে ওরা পাল্টে যান। তারা একটি বৈঠকে ডেকে নিয়ে প্রার্থিতা থেকে সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন। এ সময় তাকে নিয়ে নানা ধরনের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। দিরাইয়ে বাগানবাড়িতে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে তাকে বক্তব্য দিতে দেয়া হয়নি। এ কারণে তিনি বৈঠক ছেড়ে চলেও আসেন।
বুধবার পাথারিয়া ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে যেতে চেয়েছিলেন চঞ্চলা। কিন্তু ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাকে জানিয়ে দিয়েছেন আরেক চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন তার মামা। এ কারণে তাকে ওই ইউনিয়নে মতবিনিময় করতে দেয়া হবে না। দিরাইয়ের তাড়ল ও জগদল ইউনিয়নে তার সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়। এসব বিষয় তিনি নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন বলে জানান।
চঞ্চলা বলেন, সবাই সদলবলে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে। অথচ আমাকে দেয়া হচ্ছে পদে পদে বাধা। প্রায় ১৭ বছর আগে স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডনে গিয়েছিলেন চঞ্চলা দাস। এরপর স্বামীকে নিয়ে যান লন্ডনে। এখন তারা ওখানেই বসবাস করছেন। জনগণের সেবা করার মানসিকতা নিয়ে তিনি এবার দেশে এসে চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়েছেন। কিন্তু নির্বাচনী বাষ্পেই তিনি অবাক হয়েছেন। এরপরও বলেছেন, ‘মাঠ ছাড়বেন না। নির্বাচন করবেনই।’ এমজমিন
১০ ডিসেম্বর,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসবি