ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে : ঝোরে কাঁদছিলেন সাহেনা বেগম। কোনোভাবেই তার কান্না থামছে না। কেঁদে কেঁদে বলছেন, আমার বিয়ের জন্যই এ ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়া হয়েছিল। ২৪শে এপ্রিল আমার বিয়ে। কিন্তু এখন ঘরে কিছুই নেই। গতকাল সিলেটের শিববাড়ির জঙ্গি আস্তানা আতিয়া মহলজুড়ে ছিল কান্নার রোল। জঙ্গিবিরোধী অভিযানে তছনছ হয়ে গেছে আতিয়া ভবন।
ওলটপালট হয়ে গেছে ২৮ সংসার। আর আতিয়া মহলের নিচতলা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মেঝেতে লেগে আছে রক্তের দাগ। অজস্র বুলেটের দাগ আতিয়ার দেওয়াল জুড়ে। লাশপচা গন্ধও আছে ঘরে। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের দুটি কক্ষ কালচে হয়ে গেছে। দরজা-জানালা সবকিছুই ভেঙে চুরমার। এমন পরিস্থিতিতে আতিয়া মহল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। ভবনের ১৫০টি কক্ষের প্রায় সবকটি দরজাই ভাঙা। এ কারণে ভবন থেকে মালামাল সরাতে গোটা দিনই ব্যস্ত ছিলেন বাসিন্দারা।
তারা জানিয়েছেন, আর ফিরতে চান না আতিয়া মহলে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসায় শুকরিয়া আদায় করেন কেউ কেউ। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে আনায় সেনাবাহিনীকেও ধন্যবাদ জানান তারা। অপারেশন ক্লিয়ার আতিয়া মহল সমাপ্ত করে সোমবারই পুলিশের কাছে আতিয়া মহল হস্তান্তর করে র্যাব। এরপর পুলিশ আতিয়া মহলের দায়িত্ব নিয়ে রাতেই সিআইডি ও পিবিআইয়ের ক্রাইমসিন ইউনিটকে আলামত সংগ্রহে নামায়। রাতে পুরো আতিয়া ভবন থেকে আলামত সংগ্রহ করা হয়।
সকাল ১০টায় মহানগর পুলিশের ডিসি নর্থ বাসুদেব বণিক ও এডিসি জেদান আল মুছা আনুষ্ঠানিকভাবে আতিয়া মহল মালিক উস্তার আলীর কাছে হস্তান্তর করে। তবে হস্তান্তর করলেও আতিয়া ভবনের বাইরে মোগলাবাজার থানার ওসি খায়রুল ফজলের নেতৃত্বে একদল পুলিশ অবস্থান করে দিনভর। ওসি জানিয়েছেন, আতিয়া ভবন হস্তান্তর করলেও উদ্বেগ-উৎকণ্টা কাটাতে পুলিশ অবস্থান করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ভবন হস্তান্তরে পর আর কিছুদিন হয়তো পুলিশ মোতায়েন থাকবে বলে জানান তিনি।
সিলেট মহানগর পুলিশের এডিসি জেদান আল মুছা বলেন, সকালে বাসার সব ভাড়াটিয়াকে খবর দেয়া হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের নাম পুলিশ লিপিবদ্ধ করেছে। এরপর বাসার মালিকের সঙ্গে সর্ব প্রথম ভাড়াটিয়াদের আতিয়া ভবনের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। কারণ, আতিয়া ভবনে ২৮ পরিবারের সম্পদ রয়েছে। পুলিশও আতিয়া ভবনে ঢুকেনি। ভাড়াটিয়ারা তাদের মালামাল যাতে সহজে বুঝে পান, সে কারণেই এ ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়।
সকালের দিকে আতিয়া ভবনের মালিক উস্তার আলী জানিয়েছেন, পুলিশ বিধ্বস্ত ভবনটি তার কাছে হস্তান্তর করেছে। এরপর তিনি ২৮ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসার ভেতরে ঢুকেছেন। যারা যার ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়াদের ঢুকিয়ে দেয়া হয় বলে জানান। তবে তিনি জানান, বাসায় কেউ থাকতে পারবেন না। কারণ, বাসাটি ঝুঁকিপূর্ণ। দরজা-জানালা ভাঙা। এ কারণে ভাড়াটিয়া চলে যাচ্ছেন।
এদিকে পুলিশ ভবনের মালিক উস্তার আলীর কাছে ভবনটি সমঝে দেয়ার প্রায় এক ঘণ্টা আগে অর্থাৎ সকাল ৯টা থেকে ২৮ ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা এসে পৌঁছেন আতিয়া ভবনের সামনে। এ সময় ভাড়াটিয়া পরিবারগুলোকে কেবল মাঠে নিয়ে আসা হয়। এ সময় উস্তার আলী নিজেই সব ভাড়াটিয়াকে শনাক্ত করেন। পরে তিনি তাদের নিয়ে বাড়িতে ওঠেন। আতিয়া মহলের নিচতলা বিধ্বস্ত। নিচ তলায় রয়েছে মোট ৬টি ফ্ল্যাট। এর মধ্যে জঙ্গিদের অবস্থান ছিল কর্নারের ফ্ল্যাটটি। অন্য চারটি ফ্ল্যাটে ছিলেন অন্যান্য ভাড়াটিয়া।
অভিযানের সময় সেনাবাহিনী বেশ সতর্কতার সঙ্গে ২৮ পরিবারের ৭৮ জন সদস্যকে উদ্ধার করে। জঙ্গিদের ফ্ল্যাটের দেয়াল ভাঙা। সামনের অংশ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে। কোনো দরজা-জানালার অস্তিত্ব নেই। দেয়ালও ভাঙা। এর মধ্যে মাস্টার বেডরুম ও পাশের বেডরুম দুটি কক্ষই কালচে হয়ে গেছে। অজস্ত্র গুলির চিহ্ন রয়েছে দেয়ালজুড়ে। ওই ফ্ল্যাটের কাছের একটি ফ্ল্যাটে দেখা গেছে রক্তের চিহ্ন। দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল ওই স্থান থেকে। জঙ্গিদের কারও লাশ ওই স্থানে পড়েছিল বলে ধারণা করেন সবাই।
জঙ্গিদের ফ্ল্যাট ছাড়াও নিচতলার আরও ৫টি ফ্ল্যাটের দেয়াল ভাঙা রয়েছে। দরজা ভাঙা। জানালার থাই এলোমিনিয়াম ভাঙা। প্রতিটি ফ্ল্যাটের আসবাস একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। অন্যান্য আসবাব খাট, টেবিল ও চেয়ার ভেঙে গেছে। দেয়ালে রয়েছে বেশ কয়েকটি ফুটো। এ দিয়ে গ্রেনেড ছুড়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আতিয়া মহল বিশাল বড় ভবন। কিন্তু সিঁড়ি খুবই ছোট। এ সিঁড়িতেই জঙ্গিরা বিস্ফোরক রেখেছিল। ফলে সিঁড়িটি হয়ে উঠেছিল বিপজ্জনক।
আতিয়া মহলের দুই তলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত পাড়ি দিতে গতকাল বারবার কানে ভেসে আসে কান্নার রোল। বিভিন্ন ফ্ল্যাটের দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন বসবাসকারীরা। ফ্ল্যাটে ঢুকে অঝোরে কাঁদছিলেন ফেঞ্চুগঞ্জের কৃষি কর্মকর্তা শাহেনা বেগম। তার বাড়িও দক্ষিণ সুরমায়। ২৪শে এপ্রিল তার বিয়ে। আর বিয়ে উপলক্ষে গেল মাসে সাহেনা দুলাভাই ও বোন বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সাহেনা জঙ্গি অভিযানের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ফ্ল্যাটে আটকা ছিলেন। সেনাবাহিনী তাকে উদ্ধার করে। গতকাল এসে ফ্ল্যাটের অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল আতিয়া মহলের পরিবেশ।
ওই মহলের তৃতীয় তলার ভাড়াটে বাসিন্দা রিপা আক্তার। তিনিও ফ্ল্যাটে গিয়ে প্রথমে ভড়কে যান। পুরো ফ্ল্যাটই তছনছ করা। তবে আলমারি খুলে রিপা কিছুটা স্বস্তি পান। তিনি বলেন, প্রায় লক্ষাধিক টাকা ছিল আলমারিতে। ছিল স্বর্ণও। কোনো কিছুই খোয়া যায়নি। কেবল তার জিনিস ভাঙচুর হয়েছে। তবে প্রাণে রক্ষা পাওয়ায় তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন। আর ধন্যবাদ জানান সেনাবাহিনীকে।
রবিউল আলম নামের আরেক ভাড়াটে বলেন, তার ফ্ল্যাটে প্রায় দুই লাখ টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। তিনি এজন্য ক্ষতিপূরণ চাইবেন। এদিকে ফ্ল্যাটের অধিকাংশ বাসিন্দাই এখন নিঃস্ব। বিশেষ করে নিচতলা ও দুতলার বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এদিকে আতিয়া মহল ছাড়া আরও দুটি ভবনেও গতকাল ফিরেছেন ভাড়াটিয়া। এর মধ্যে আতিয়া মহল-২ তেও অনেক জিনিস তছনছ করা। ভাড়াটিয়ারা জানালেন, তারা এখনো সব কিছু দেখেননি। ভবনের মালিক উস্তার মিয়া জানালেন, গতকালই তিনি ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে এসেছেন। তাদের ভবন দেখাচ্ছেন। এরপর তাদের সিদ্ধান্ত মতো তিনি পরবর্তী কার্যক্রম চালাবেন। এমজমিন
১২ এপ্রিল ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি