শীতলপাটির হাট
উজ্জ্বল মেহেদী: নিপুণ হাতের বুননে তৈরি বেতের পাটি মোড়ানো হয়েছে পরিপাটি করে। গ্রামের হাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের পাশে সেগুলো দণ্ডায়মান করে রাখা। ক্রেতা-বিক্রেতারা তা দাঁড়িয়ে দেখছেন। দরদাম ঠিক হলে মোড়ানো পাটি খুলে মাটিতে বিছিয়ে চলে আরেক পলক দেখাদেখি।
এ হচ্ছে মুরতা বেতের পাটি। সিলেটের বিখ্যাত শীতলপাটি নামেও পরিচিত এটি। বেতজাতীয় গাছ মুরতা থেকে হাতে বুনিয়ে করা এ পাটির বেচাকেনা গ্রামের হাটে ভালোই জমে। বর্ষা শেষের এ মৌসুমে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সালুটিকর বাজারে জমে ওঠে মুরতা বেতের এই পাটির হাট।
সালুটিকর সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার একটি গ্রাম্য হাট। তবে এর অবস্থান তিন উপজেলার মধ্যবর্তী স্থানে। সালুটিকর দর্শন যেন একসঙ্গে তিন উপজেলা মাড়ানো। সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট—এ তিন উপজেলার মাঝামাঝি অবস্থানে থাকায় পাটির এ হাটটি সব সময়ই জমজমাট থাকে।
একদিকে নৌকার হাট, তার ওপাশেই পাটির হাট। সালুটিকরে এ পাটির হাটের কদরের পেছনে কারণ আছে। সিলেটের যেসব উপজেলায় বন বিভাগের মুরতা বেতের বাগান ‘সৃজন’ রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগ গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায়। সালুটিকর বাজার লাগোয়া বন বিটের ৩৫০ একর জমিতে রয়েছে পাটি বুননের কাঁচামাল মুরতা বেত। শুষ্ক মৌসুমে রোপণ করা এই বেত পরিপক্ব হলে বর্ষার পানিতে ভিজিয়ে পাটি তৈরির উপযোগী বেতে রূপ দেওয়া হয়। এরপর চলে পাটি বুননকর্ম। এ কাজ সাধারণত কৃষক পরিবারের গৃহিণীরাই করেন।
সালুটিকর হাট ঘুরে এবার বুননকর্মী নারীদেরও উপস্থিতি দেখা গেছে। কথা হয় গোয়াইনঘাটের ফতেপুর গ্রামের আফিয়া বেগম, আঙ্গারজোর গ্রামের স্বরূপা আক্তার ও শহরবানু নামের এমনই তিন নারী বুননকর্মীর সঙ্গে। আফিয়া বলেন, ‘মুরতা রইছি (রোপণ), পাটিও বানছি (বুনন)। আমরার এক হাতে দুই কামওর দাম পাইতে বাজারও আইছি।’ আফিয়া জানান, যে হাতে মুরতা বেত রোপণ করেছেন, সেই হাতেই পাটি বুনেছেন—বিষয়টি হাটে এসে প্রকাশ করার মধ্যে ক্রেতা আকর্ষণ বাড়ে।
পাটি সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প। সিলেটের বালাগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার মূলত এ শিল্পের আদিস্থান। এ ছাড়া সিলেটের গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ছাড়াও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, জগন্নাথপুর ও হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলায় দুই শতাধিক গ্রামে পাটি বুনন ঐতিহ্যবাহী কাজ।
সিলেট অঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে উপঢৌকন হিসেবে বর-কনেকে পাটি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এখনো গ্রাম এলাকায় কনে ‘নাইওর’ (বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া) থেকে হাতে পাটি নিয়ে ফেরেন। গ্রীষ্মকালে শীতল পরশের জন্য বেড়ে যায় শীতলপাটির কদর। পাটির সঙ্গে ‘শীতল’ নামকরণের মাহাত্ম্য এখানেই। শহুরে গৃহসজ্জায়ও ব্যবহৃত হয় শীতলপাটি। চাহিদা আছে বিদেশেও।
এই শীতলপাটিরও রয়েছে নানা নাম আর জাত। এর মধ্যে ‘পয়সা’, ‘সিকি’, ‘শাপলা’, ‘সোনামুড়ি’, ‘টিক্কা’ নামের পাটির ব্যবহার গ্রামের গৃহস্থ পরিবারে বেশি। এ ছাড়া অভিজাত পাটি হিসেবে ‘লালগালিচা’, ‘আধুলি’, ‘মিহি’ চাহিদা অনুযায়ী তৈরি করা হয়। বিক্রি হয় ৩০০ থেকে দুই হাজার টাকায়।
ক্রেতা-বিক্রেতারা জানান, বর্ষার এক মাস ও বর্ষা শেষের দুই মাসেই মূলত বসে পাটির হাট। সালুটিকর হাটের ইজারাদার সুনাই মিয়া জানান, এ পাটির হাটে প্রতিদিন গড়ে শতাধিক পাটি বেচাকেনা হয়। এ হিসেবে বর্ষার আগে ও পরে কমপক্ষে ১০ হাজার পাটির বেচাকেনা হয়।প্রথম আলো
২৬ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ