ওয়েছ খছরু: চায়ের সঙ্গে নেশাজাতীয় দ্রব্য খাওয়ানো হয় সুলতানাকে(ছদ্ধনাম)। এরপর বন্দরবাজারের একটি হোটেলে নিয়ে রাতভর তার সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা করে প্রেমিক বাহার। সেই থেকে সতীত্ব হারিয়ে বাহারের কাছে সঁপে দিয়েছিল সবকিছু। তিন মাস একই ছাদের নিচে ঘর-সংসার করেছে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে ভালোবাসার মানুষ বাহারই তার সঙ্গে করেছে প্রতারণা। এখন অনেকটা নিঃস্ব সুলতানা। ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে। কেউ সহানুভূতি জানাচ্ছেন। কেউ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।
সিলেটের এই সুলতানার কাহিনী বড়ই করুণ। সুলতানার পূর্বনাম রমারানী নাথ। বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমার কঠালপুর গ্রামে। পড়তো হাইস্কুলে। বয়স যখন ১৪ বছর তখন থেকে সে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়। পিতার ঘরে বসবাস করার সময়ই পাশের বাড়ির এক মহিলার কাছে কোরআন শিক্ষায় দীক্ষা নেয়। বিষয়টি জানাজানি হয় তার পরিবারে। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর পরিবার থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। সুলতানা চলে আসেন সিলেটে। আশ্রয় নেন নগরীর দাড়িয়াপাড়ার একটি বাসায়। সেখান থেকে তিনি জল্লারপাড় এলাকায় দর্জির কাজ শেখেন। নিজের মনোবলের কারণে অল্প দিনেই সুলতানা ‘দর্জি মাস্টার’ হয়ে ওঠেন।
এরপর তিনি নিজেই মেশিন কিনে জল্লারপাড় এলাকায় বাসা নিয়ে ট্রেনিং দেয়া শুরু করেন। মাঝে মধ্যে পাড়ার মহিলাদের কাপড় সেলাই করেন। এভাবেই চলছিল সুলতানার জীবন। কিন্তু হঠাৎ তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। জল্লারপাড় এলাকার লিয়াকত ভবনের সাইফুরস-এ লিফলেট কর্মচারী হিসেবে কাজ করতো জৈন্তাপুরের হরিপুর এলাকার উপর শ্যামপুর দলইরপাড়া এলাকার সাঈদ উল্লাহ ছেলে বাহার উদ্দিন রিপন। একই এলাকায় বসবাসের সুবাদে সুলতানার ওপর নজর পড়ে তার। কাজের মেয়ে শিল্পীর মাধ্যমে সুলতানার মোবাইল ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে বাহার। এরপর সে সুলতানাকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়।
কিন্তু সুলতানা তার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে সে। বারবার ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করে। এক সময় আত্মহত্যারও হুমকি দেয়। বিষয়টি সুলতানা অবগত করে জল্লারপাড়ের বাসার মালিক খসরু মিয়াকে। এলাকার লোকজনকে বিষয়টি জানানো হয়। এদিকে বাহার উদ্দিন রিপনের যন্ত্রণায় মোবাইল ফোনের নাম্বার পরিবর্তন করেন সুলতানা। বাহার তাকে মোবাইল ফোনে না পেয়ে বাসায় চলে যায়। এ নিয়ে এলাকাবাসী বাহারের ওপর চরম ক্ষুব্ধ হন। ওই সময় বাহারের মা রায়না বেগম সুলতানাকে পুত্রবধূ করতে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বলেন।
এলাকাবাসীর পরামর্শ নিয়ে বাহারের মায়ের প্রস্তাবে সুলতানা ২০১৫ সালের ১৭ই নভেম্বর হরিপুরে যায়। ওই দিন রাতেও বাহারের বাড়িতে অবস্থান করে সুলতানা। তাদের আতিথেয়তায় সুলতানা মুগ্ধ হন। এদিকে, ১৮ই নভেম্বর বিকালে বাহার সুলতানাকে নিয়ে চলে আসে সিলেট শহরে। সন্ধ্যায় তারা জিন্দাবাজারের রেস্টুরেন্ট জলসিঁড়িতে চা খেতে বসে। এমন সময় বাহার চায়ের সঙ্গে সুলতানাকে নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করায়। এরপর থেকে আর কিছুই বলতে পারেন না সুলতানা। ১৯শে নভেম্বর সুলতানা নিজেকে আবিষ্কার করেন বন্দরবাজারের হোটেল মহানগরে। সকালের দিকে দেখেন রাতেই হোটেল কক্ষে বাহার তার ইজ্জত লুট করেছে। এতে ক্ষিপ্ত হন সুলতানা।
এ ঘটনা থেকে রক্ষা পেতে বাহার সুলতানাকে নিয়ে পরদিন যায় সিলেটের দরগাহ গেট এলাকার কাজী অফিসে। সেখানে গিয়ে সহকারী কাজী সুবহান বোগদাদীর কাছে বিয়ের কথা বলেন। কিন্তু দুজনের ভোটার আইডিসহ জরুরি কাগজপত্র সঙ্গে না থাকায় কাজী কাবিন করতে রাজি হননি। একপর্যায়ে তিনি সাদা কাগজে দুজনের স্বাক্ষর রেখে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে পড়িয়ে দেন। কথা ছিল পরে কাগজপত্র নিয়ে যাওয়ার পর কাবিন রেজিস্ট্রি হবে। এদিকে বিয়ের পর বাহার নগরীর মাছুদিঘিরপাড়ের রানীর গলির ৩৯-২ নম্বর বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে তারা স্বামী স্ত্রী হিসেবে বসবাস শুরু করেন। এদিকে, স্বামী স্ত্রী হিসেবে বসবাসের সময় সুলতানা কাবিনের জন্য চাপ প্রয়োগ করলে ক্ষেপে যায় বাহার। কাবিনের কথা উঠলেই সে অকথ্য নির্যাতন করে সুলতানাকে। আর বিষয়টি এলাকাবাসীরও নজরে আসে।
ওই সময় এলাকাবাসীর রোষানল থেকে রক্ষা পেতে ৫০ টাকার একটি স্ট্যাম্পে বাহার সুলতানাকে স্ত্রী হিসেবে বৈধতা দিয়ে দস্তগত দেয়। তিন মাস বসবাসের পর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে বাহার সুলতানার জমানো ৮০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যায়। আর ফিরেনি। এ অবস্থায় সুলতানা শুরু করেন বাহারের খোঁজ। কাজী অফিসে গিয়ে ওই কাগজ চান। ওই কাগজে বাহার তার মূল বাড়ি জৈন্তাপুরের পরিবর্তে গোয়াইনঘাট লেখে। ওদিকে, সুলতানার কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর বাহার ও তার পরিবারের সদস্যরা মোবাইল ফোনের নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলে। বাধ্য হয়ে সুলতানা স্থানীয় ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদের কাছে বিচারপ্রার্থী হন। রশীদ আহমদ বিষয়টি সালিশের মাধ্যমে মীমাংসা করে মার্চের প্রথমদিকে সুলতানাকে স্বামী বাহারের ঘরে তুলে দেন।
কিন্তু ঘরে তোলার দিনই সুলতানাকে বাহার ও তার মা রায়না বেগম ব্যাপক মারধর করে। এ সময় তারা সিলেট শহর থেকে কয়েকজন পুরুষকে ডেকে নিয়ে সুলতানাকে গুম করার চেষ্টা চালায়। ওই সময় হরিপুর এলাকার মাদরাসা শিক্ষকসহ স্থানীয়রা হস্তক্ষেপ করায় বিষয়টি বেশিদূর গড়ায়নি। এরপর সুলতানা চলে আসেন সিলেটে। এখন তিনি নগরীর শেখঘাট এলাকায় বসবাস করছেন। সুলতানা জানিয়েছেন, তার শাশুড়ি রায়না বেগম ও স্বামী বাহার প্রথমে ভালো মানুষের অভিনয় করেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা রুক্ষ হয়ে ওঠে। তার শ্বশুর সাঈদ উল্লাহ তাবলিগ জামায়াতের সদস্য হওয়ায় স্ত্রীর অবাধ স্বাধীনতায় ওই পরিবারের সদস্যরা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, তিনি আর স্বামী চান না। তার সঙ্গে যে ধোঁকাবাজি হয়ে সেটির ন্যায় বিচার চান। আর তার কাছ থেকে লুট করা ৮০ হাজার টাকা ফেরত চান। সামাজিকভাবে বিচার না পেয়ে তিনি এখন আইনের শরণাপন্ন হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তিনি একটি আইনি সহায়তা প্রদান সংস্থার কাছে নালিশ করেছেন। তারা তার বক্তব্য শুনে তদন্তে নেমেছেন। এদিকে, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা সিলেটের প্যানেল অ্যাডভোকেট পারভিন আক্তার লিজা জানিয়েছেন, মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। যেহেতু ইউনিয়ন চেয়ারম্যানসহ সামাজিক ব্যক্তিবর্গ বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, সেহেতু মেয়েটি ন্যায় বিচার পাবে।
জৈন্তাপুরের ফতেহপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রশিদ আহমদ জানিয়েছেন, তিনি সামাজিকভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে সুলতানাকে স্বামীর ঘরে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ওপর নির্যাতন চলার কারণে শেষ মুহূর্তে চলে যায়। সুলতানার স্বামী বাহার স্বাভাবিক মানুষ নয় বলে দাবি করেন তিনি। এদিকে, ১৫ বছর বয়সে বাহার গোলাপগঞ্জের জঙ্গলহাটার রুনা আক্তারকে বিয়ে করেছিল। ওই স্ত্রীর ঘরে হাবিবা নামে ৭ বছরের এক মেয়ে সন্তান রয়েছে। বাহারের বহুগামিতার কারণেই তার ওই স্ত্রী তালাক দিয়ে চলে যায়।-এমজমিন
১৪ মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ