ওয়েছ খছরু: কানাডিয়ান বধূ সিলারার ছলনায় মৃত্যুর মুখোমুখি সিলেটের যুবক সায়েক। সিলারার দুলা ভাইদের ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা রাতের আঁধারে তাকে অপহরণ করে নির্জন স্থানে নিয়ে নির্মম ভাবে নির্যাতন চালিয়েছে। নির্যাতনের দুই দিন পর ফিরেছে সায়েকের জ্ঞান। এখন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছেন তিনি। আর এ ঘটনার পর সিলারার ছলনা ও তার আত্মীয়দের নিষ্ঠুরতা যারাই শুনছেন তারাই শিউরে উঠছেন। সায়েকের পুরো নাম সায়েক আহমদ খান। বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার মছকাপুর গ্রামে। পিতা মুজিবুর রহমান। সায়েক ছিলেন দুবাই প্রবাসী। আর সিলারা বেগম কানাডা প্রবাসী। থাকেন ওখানকার মন্টিল শহরে। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার তেরাদল কাকরদি গ্রামে। পিতা মৃত আজমল হোসেন চৌধুরী। কয়েক বছর আগে এক আত্মীয়কে বিয়ে করে কানাডা পাড়ি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পূর্বের স্বামী শারীরিকভাবে অক্ষম থাকায় অবশেষে সমঝোতার মাধ্যমে ওই স্বামীর কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা গ্রহণ করে ডিভোর্স দেন সিলারা। এরপর থেকে সিলারা বসবাস করছিলেন মন্টিল শহরে এক আত্মীয়ের বাসায়।
গত বছরের মে মাসে নিজের বাড়ি বিয়ানীবাজারে আসেন সিলারা। এ সময় আত্মীয়রা তার জন্য নতুন করে স্বামী দেখা শুরু করেন। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে সায়েকের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়। পারিবারিকভাবে বিয়ের মোহরানা নির্ধারণ করা হয় ১০ লাখ টাকা এবং মোহরানা বিয়ের পরপরই দিতে হবে জানিয়ে দেন সিলারা। বিয়ের কথাবার্তা চূড়ান্ত হওয়ার পর ২০১৫ সালের ১১ই জুন বিয়ানীবাজারের সুপ্রিম সেন্টারে সিলারা ও সায়েকের বিয়ে হয়। মহাধুমধামে আয়োজিত বিয়েতে ছিলেন উভয়পক্ষের আত্মীয়স্বজন। বিয়ের পরপরই কথা মতো মোহরানা প্রদান করেন সায়েক। কিন্তু বিয়ের অল্পদিনের মাথায় সিলারা জরুরি কাজ আছে বলে জানিয়ে স্বামীকে দেশে রেখেই চলে যান কানাডায়। এর কিছু দিন পর ভিসা বাতিল করতে দুবাই চলে যান সায়েকও। স্বামী-স্ত্রী দুজন দুই দেশে থাকলেও তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। এদিকে, সিলারা কানাডা যাওয়ার পর স্বামী সায়েককে দেশ থেকে আবেদন করার প্রস্তুতি নিতে জানিয়ে দেয়। এর ফলে সায়েক ভিসা বাতিল করে দুবাই থেকে চলে আসেন সিলেটে। উপশহরের একটি ল’ ফার্মে গিয়ে কানাডায় আবেদনের প্রস্তুতি শুরু করেন। ওদিকে, কানাডা আবেদনের একপর্যায়ে সিলারার পূর্বের স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের কাগজপত্রের প্রয়োজন পড়ে।
এ কারণে সায়েক সিলারার কাছে ওই কাগজ চান। কিন্তু সিলারা কাগজ দিচ্ছে, দেবে বলে কয়েক মাস কাটিয়ে দেয়। একপর্যায়ে জানায়, সে ওই কাগজ দিতে পারবে না। এদিকে, ওই কাগজ না পাঠানোর কারণে আবেদনও করা যাচ্ছে না। এ নিয়ে সিলারার সঙ্গে সায়েক ও তার পরিবারের বিরোধ বাধে। বিরোধের একপর্যায়ে কানাডার আত্মীয়ের মাধ্যমে সায়েকের পরিবার খবর পায় সিলারা কানাডায় গোলাপগঞ্জের তাজউদ্দিন নামের এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সায়েকের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর দেশ থেকে যখন সে কানাডায় যায় তখন তাজউদ্দিনের সঙ্গে আরও গভীর প্রেমে মেতে ওঠে। এক পর্যায়ে আত্মীয়ের বাসা ছেড়ে সিলারা তাজউদ্দিনের সঙ্গে বসবাস শুরু করেছে। আর এ বিষয়টি জানার পর সায়েকের পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তারা দেশে থাকা সিলারার আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কাকরদি এলাকায় এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়। লন্ডন থেকে কয়েক বার যোগাযোগ করা হয় সিলারার সঙ্গে। কিন্তু সিলারা কাউকেই পাত্তা দেয়নি। প্রায় দুই মাস আগে দিলারা আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে জানিয়ে দেয় সে আর সায়েকের সঙ্গে সংসার করবে না।
আর সিলারার এই ঘোষণায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে সায়েক ও তার পরিবার। তারা জানিয়েছেন, বিয়েতে মোহরানাসহ প্রায় ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সিলারার ছলনায় সব তছনছ হয়ে গেছে। এদিকে, সর্বশেষ গেলো এক মাস ধরে সায়েক সিলারার দুলা ভাই নগরীর বাগবাড়ীর চৌধুরী মঞ্জিলের বাসিন্দা আব্দুল আহাদ ও লামাবাজারের ছায়ানীড়-৫ এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলামের কাছে বিয়ের মোহরানার টাকা দাবি করেন। একই সঙ্গে তার সঙ্গে সিলারার বিচার দাবি করেন। আর এ নিয়ে সম্পর্কিত ভায়রা ভাই আহাদ ও নজরুল সিলারার স্বামী সায়েকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এভাবেই চলছিল ঘটনা। একপর্যায়ে সায়েকের পরিবারও আহাদ ও নজরুলের কাছে মোহরানার টাকা দাবি করেন। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ হন আহাদ ও নজরুল। তারা সায়েককে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করে। সেই পরিকল্পনা মোতাবেক গত ৩০শে মে আহাদ ও নজরুল ফোনের মাধ্যমে সায়েককে মেডিকেল এলাকার পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে আসতে বলেন। এ সময় তারা ফোনে সায়েককে আশ্বস্ত করে বলেন সিলারার সঙ্গে ঝামেলা মিটমাঠের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর এই ফোন পেয়ে সন্ধ্যার দিকে সায়েক নিজ বাড়ি হেতিমগঞ্জ থেকে সিলেট নগরীর মেডিকেল রোডের পপুলারের সামনে আসেন।
এ সময় সিএনজি নিয়ে ওই এলাকায় আসেন তিন যুবক। তারা এসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা সায়েককে বলে আহাদ ও নজরুল তাদের পাঠিয়েছেন। তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। আর ওই যুবকদের দেখে সায়েকের সন্দেহ হলে তিনি ফোনে কথা বলার চেষ্টা করেন আহাদ ও নজরুলের সঙ্গে। এ সময় ওই তিন যুবক অনেকটা জোরপূর্বক সায়েককে সিএনজিতে তুলে নগরের অচেনা একটি স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে একটি কক্ষে তাকে আটকে রেখে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সায়েকের শরীরের বিভিন্ন স্থানের মাংস তুলে নেয়। রড দিয়ে আঘাত করে হাত ও পায়ের গোড়ালি ফাটিয়ে দেয়। হাঁটুর হাড্ডিও ভেঙে দেয়। একপর্যায়ে তাদের নির্যাতনের মুখে কথামতো তিনটি একশ টাকার স্টাম্পে সই দেন সায়েক। এরপর সায়েকের মাথায় রড দিয়ে আঘাত করা হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। রাতে সায়েককে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের ফটকে তাকে ফেলা রাখা হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সায়েককে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরে সায়েকের বড় ভাই লায়েকসহ আত্মীয়স্বজনরা ওসমানীতে আসেন। এদিকে, ঘটনার দুদিন পর জ্ঞান ফিরে সায়েকের। এখনও তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আর নির্মম এ ঘটনাটি নজরে আসে সিলেটের ডিসি ফয়সল মাহমুদের।
এরপর গত শনিবার রাতে সিলেটের কোতোয়ালি থানায় বাগবাড়ীর আহাদ ও লামাবাজারের নজরুলসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন সায়েকের বড় ভাই লায়েক আহমদ খান। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে মামলার আসামি নজরুলকে গ্রেপ্তার করলেও স্ত্রীসহ পালিয়েছে আহাদ। তাকে ধরতে পুলিশের অভিযান চলছে। আর গতকাল সিলেটের আদালতে হাজির করে নজরুলকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সিলেটের কোতোয়ালি থানার পুলিশ জানিয়েছে, নজরুলকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে নির্যাতনকারী তিন যুবকের খোঁজ পাওয়া যাবে। মামলার বাদি লায়েক আহমদ খান জানান, সায়েক এখনও আশঙ্কামুক্ত নয়। যেভাবে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে সে মানসিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ‘ওরা মানুষ নয়, পশু। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই আমরা।-এমজমিন
৭ জুন, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪.কম/সবুজ/এসএ