মঙ্গলবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৭, ০১:৩০:৪২

মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা-অবরোধ!

মিয়ানমারে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা-অবরোধ!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর অভিযানের প্রেক্ষিতে মিয়ানমারের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং কোন কোন ব্যক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যায় সেটিও খতিয়ে দেখছে ওয়াশিংটন। সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।

টিলারসন বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনের সঙ্গে আরো যারা জড়িত তাদের ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ভাবছে ওয়াশিংটন। আগস্টে অভিযান শুরুর পর যেসব ঘটনা ঘটেছে তার সবদিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে একজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজে দেখা হচ্ছে, যাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে ওয়াশিংটন।

মিয়ানমারের ওপর শিগগিরই মার্কিন অবরোধ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতনের জন্য দায়ীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কাজ এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। এরই মধ্যে দায়ী এক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে সেই ব্যক্তিকে তার কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। সম্ভাব্য আরো কয়েকজনের দায়ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছে তিনি।

মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কথা বলতে গিয়ে গতকাল শুক্রবার জাতিসঙ্ঘে টিলারসন সাংবাদিকদের এসব জানান। রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনে চলতি বছর আগস্ট থেকে ছয় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিজ এলাকা ছেড়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতনকে নভেম্বরে ‘জাতিগত শুদ্ধি’ অভিযান বলে ঘোষণা দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী; ওয়াশিংটন দায়ীদের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা’ আরোপের বিষয়টি চিন্তা করছে বলে সে সময় জানিয়েছিলেন তিনি। টিলারসন বলেন ‘যার কারণে মিয়ানমার থেকে বিপুল দেশান্তরের ঘটনা ঘটেছে সেই আগস্ট হামলার পর থেকে হওয়া সব ঘটনা ও পরিস্থিতি খতিয়ে দেখছি আমরা; যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার জন্য এরই মধ্যে দায়ী একজনকে চিহ্নিত করেছি, সম্ভাব্য অন্যদের বিষয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে’।

মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রাম্প প্রশাসন প্রথম পর্যায়ে সীমিত ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ বাড়ানোর লক্ষ্যে এ ব্যবস্থা নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র্। তবে এ নিষেধাজ্ঞায় সামরিক বাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্তির সম্ভাবনা নেই বলেও জানিয়েছেন তারা। মিয়ানমারের ওপর আরোপ করা যে ব্যাপক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন তা নতুন করে আরোপ করা যায় কি না, তা-ও যাচাই করে দেখা হচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

কিন্তু মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্তকারী আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনেক আইনপ্রণেতা সীমিত আকারের এ নতুন নিষেধাজ্ঞায় সন্তুষ্ট হবেন না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুধু রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান চালায়নি; বরং তাদের বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে যাতে তারা আর ফিরতে না পারে। সেই সাথে নারীদের ওপর নির্লজ্জ নির্যাতন অভিযান চালানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।

রেডক্রস বলেছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আর মাত্র তিন লাখ রোহিঙ্গা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে আবারো সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে। এখন প্রতিদিন প্রায় ৩০০ করে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। সংস্থাটি আরো বলছে, গত মাসে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছে তা ‘সম্পূর্ণ’ চুক্তি নয় এবং এ চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের এই মুহূর্তে রাখাইন রাজ্যে পাঠানো ঠিক হবে না।

ইইউ পার্লামেন্টে মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব গৃহীত

মিয়ানমারে ব্যাপকভিত্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে লক্ষ্য নির্দিষ্ট (টার্গেটেট) শাস্তিমূলক নিষেধাজ্ঞা আরোপের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এ প্রস্তাব অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও সদস্যভুক্ত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পার্লামেন্ট।

ফ্রান্সের স্টার্নসবার্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্কের ওপর ভোটাভুটির পর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিতর্কের সূচনা ও সমাপনীতে বক্তব্য রাখেন ইউরোপীয় কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ইইউর বৈদেশিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা নীতিসংক্রান্ত প্রধান ফেদেরিকা মোঘেরিনি। এতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন এমপি বক্তব্য রাখেন।

প্রস্তাবে মিয়ানমারের ওপর আগে থেকে আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আওতা আরো বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও বৈষম্য নিরসনে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর উল্লেখযোগ্য হারে চাপ বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ ও হয়রানি বন্ধ এবং তাদের বাড়িঘর পোড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য মিয়ানমার সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানান। এতে ধর্মীয় ঘৃণা ছড়ানোর সব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো, সামাজিক বৈষম্য দূর করা এবং রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা, ইইউ ও জাতিসঙ্ঘকে রাখাইন রাজ্যে মানবিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমোদন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পৃথকীকরণ বন্ধ করা এবং সীমান্তে মাইন পোঁতা বন্ধ ও ইতোমধ্যে পুঁতে রাখা মাইনগুলো অপসারণের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত বিতর্কে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ, বাণিজ্য সুবিধা বাতিল ও বিনিয়োগ চুক্তি স্থগিত করাসহ সব ধরনের শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের মতে, রোহিঙ্গারা যাতে ন্যায়বিচার পান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে। নৃশংসতার সাথে জড়িত মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। একই সাথে বাংলাদেশের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নের প্রতিও গভীর নজর রাখতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মোঘেরিনি বলেন, বাস্তব পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে আমার কথা হয়েছে। সু চির সাথেও বৈঠক করেছি। নেইপিডোতে এশিয়া-ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) সাইডলাইনে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়েছে। এরপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সাথে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে বাংলাদেশ। এ চুক্তি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না তা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

মিয়ানমার পরিস্থিতিকে জটিল হিসেবে আখ্যায়িত করে মোঘেরিনি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় ইইউকে একসাথে দুই দিক সামাল দিতে হচ্ছে। প্রথমত, মিয়ানমারের নবীন গণতন্ত্রকে রক্ষা করা, যাতে ঘড়ি পেছনের দিকে ঘুরে না যায়। দ্বিতীয়ত, আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারে ওপর চাপ সৃষ্টি। এটি একটি কঠিন কাজ। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুটি এখন আর মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নয়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রয়োজন ছিল। এটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এখন রোহিঙ্গাদের মর্যাদার সাথে ফেরানোর কঠিন কাজটায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন প্রয়োজন হবে।-রয়টার্স
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে