বিনোদন ডেস্ক : ‘বেবি’, ‘ফ্যান্টম’, ‘এয়ারলিফট’ কিংবা আপকামিং ‘নীরজা’- বলিউডে কেন এত দেশাত্মবোধক সিনেমার ছড়াছড়ি?
আপাতভাবে মনে হতে পারে, মেইনস্ট্রিম হিন্দি ছবি বুঝি স্রেফ নাচে, গানে বিনোদনের পসরা সাজিয়ে রাখে। কিন্তু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, হিন্দি সিনেমা, যা এখন বলিউড সিনেমা নামে পরিচিত, তা কিন্তু সমাজ বাস্তবতা রহিত নয়। বরং সময়ের চাহিদা মেনেই বদলে বদলে যায় সিনেমার বিষয়ের গতিপথ।
ঠিক যেমন ৫০-৬০এর দশকের রোমান্সের বাসরকুঞ্জ সরিয়ে রেখে গনগনে সময়ে মানুষের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দাবীতে আবির্ভাব হয়েছিল অ্যাংরি ইয়ং ম্যানের, ঠিক যেভাবে বিশ্বায়ন উত্তর দুনিয়ায় শাহরুখ খান হয়ে উঠলেন ‘ডায়াস্পোরা ডার্লিং’, সেভাবেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সাম্প্রতিক অতীতের একাধিক দেশাত্মবোধক সিনেমাও।
এ দেশে চলচ্চিত্রের প্রভাব যে বই ও সংবাদপত্র্রের মিলিত প্রভাবের থেকেও বেশি হবে, এমনটাই মনে করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুজি। কেননা হিন্দি সিনেমা বরাবরই সমাজবদলের ইস্তেহারটি অতি গোপনে পাচার করে দেয় দর্শকরে মননে।
যখন ব্রিটিশরা এ দেশের প্রভু ছিলেন, তখনও দেশে সিনেযাত্রার একেবারে গোড়ার দিকে, ছবিতে ছবিতে মিথের ব্যবহার করা প্রায় রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রিটিশ নজরদারীর ভিতরে থেকেও দেশের ঐতিহ্য সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করতে এই ছিল পন্থা।
পাশপাশি জনপ্রিয় কাহিনির দৌলতে নতুন শিল্পের জনপ্রিয়তা আদায়ের প্রসঙ্গ তো ছিলই। এমনকী নকলনবীশ দেশবাসীকে শ্লেষের চাবুক মারতে তৈরি হয়েছিল ‘বিলাত ফেরত’-এর মতো ছবি।
ঠিক এ কারণেই দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের শেষপর্বে যে নারীপ্রধান সিনেমার প্রসার হয়েছিল৷ গান্ধীজির অহিংশ নীতি ও দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান প্রভাব ফেলেচিল হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্যেও।
এই প্রসঙ্গেই স্মরণীয়, চারের দশকে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ ও আইপিটিএ-র কথাও৷ ভারতীয় সিনেমার শোণিতে এসেচিল অন্যরকম চেতনার প্রবাহ।
এই পথ ধরেই পরবর্তীতে এগিয়েছে হিন্দি সিনেমা। বহিরঙ্গে নাচ-গানের ফর্মূলা অনুসরণ করলেও, চিত্রনাট্যের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এই দিকবদলের ইঙ্গিত।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে পুলিশ তথা কোর্টের প্রতি হিন্দি সিনেমা যে আস্থাজ্ঞাপন করত তার কারণও ছিল প্রশাসনের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখা। জনপ্রিয়তার ফর্মূলা মেনেই সামাজিক ভালো মন্দের দিকগুলো এভাবেই বারবার এসেছে সিনেমায়৷ অ্যাংরি ইয়ং ম্যান হিসেবে অমিতাভ বচ্চনের উত্থানও তাই যত না রাজেশ খান্নার ঔদ্ধত্যের কারণে প্রযোজক-পরিচালকদের ক্ষোভের কারণে, তার থেকেও বেশি সময়ের রাগ, হতাশা ও মানুষের স্বীয় অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার দাবীতেই।
আবার বিশ্বায়ন পরবর্তী সিনেমায় দেখা যাবে অন্য এক দেশ গড়ার ইঙ্গিত৷ গ্লোবাল ভিলেজের ধারণাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েই প্রবাসীদের মন ছুঁয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দেখা গেল এই পর্বের সিনেমায়৷ আর এখানে দেশাত্মবোধ শুধু দেশাত্মবোধক গানে নয়, এল ‘লগান’-এর মতো সিনেমার হাত ধরে।
ভারতীয় মেয়ে গঙ্গা যখন ‘আই লাভ মাই ইন্ডিয়া’ গেয়ে উঠল বিদেশের মাটিতে তখনই প্রতিষ্ঠিত হল কাঙ্ক্ষিত জাতীয়তাবোধ৷ কিংবা আরও পরবর্তীকালের সিনেমায় যে দেশাত্মবোধের প্রকাশ আমারা দেখি ‘বীরজারা’ বা ‘চক দে’র মতো সিনেমায়।
ভারত পাকিস্তান সীমান্ত সমস্যা যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, তখন বলিউড ঝুঁকেছে বর্ডার কিংবা ‘এলওসি কার্গিল’-এর মতো ছবির দিকে।
এখন আবার ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’-এর মতো ছবি এসে দু’দেশের অধিকাংশ মানুষের মনের কথাটি বলে দিয়ে যাচ্ছে। ঠিক একই দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে ‘ফিল্মিস্তান’ ছবিতেও। কাশ্মীর সমস্যা যখন দেশের মাথায় চিরস্থায়ী ক্ষত হয়ে বসে আছে, তখনই বানানো ‘হায়দার’-এর মতো ছবি। আম আদমির হয়ে বলার কথা বলে দিতেই আসে ‘আ ওয়েডনেসডে’৷
আসলে এ সবই শুধু ব্যবসার খাতিরে নয়। অবশ্যই সিনেমা শিল্পে ব্যবসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা মাথায় রেখেও বৃহত্তর জনসাধারণের বাসনাটিও অন্তর্নিহিত থাকে এইসব সিনেমার গভীরে।
দেখা গিয়েছে, ঠিক যখন যখন জাতীয়তাবোধের উত্থান জরুরী হয়েছে, এক দেশ, এক জাতির বোধ আবার নতুন করে জাগানোর সময় হয়েছে, তখন হিন্দি ছবিও লেগে পড়েছে সে কাজে৷ এখন যখন ফ্যান্টম, বেবি থেকে এয়ারলিফট বা নীরজার মতো সিনেমার ছড়াছড়ি, তখন হিন্দি সিনেমার উদ্দেশ্য বুঝতে অসুবিধা হয় না।
অর্থনৈতিক সংস্কার থেকে শিল্পায়ণ, কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি রাজনীতির চোরাগলিতে যখন ঘুরপাক খাচ্ছে, যখন অসহিষ্ণুতা বিতর্ক বারবার করে মাথাচাড়া দিচ্ছে, টাকা-ডলারের হিসেব যখন ভয় দেখাচ্ছে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে তখন দেশ তথা সিস্টেমের প্রতি বিরাগ জন্ম নেওয়া প্রত্যাশিত। ঠিক সেখান থেকেই দেশবাসীকে দেশের প্রতি আস্থাশীল করে তুলতে প্রয়াস হিন্দি সিনেমার। খেয়াল করলে দেখা যাবে এই সময়ের অধিকাংশ সিনেমাই সিক্রেট এজেন্সির কাজকর্মকে গুরুত্ব দিচ্ছে, যেমন, বেবি বা ফ্যান্টম। অর্থাৎ আপাতভাবে যা করা সম্ভব হচ্ছে না, অথচ দেশবাসীর যা প্রত্যাশা, তা পূরণ করে দিচ্ছে হিন্দি সিনেমা। সেখানে মুম্বই হামলার নাটের গুরুকেও তাই খতম করা যাচ্ছে৷ এবং দ্বিতীয়ত, একক কৃতিত্বকেই তুলে ধরা হচ্ছে।
যেমন, এয়ারলিফট বা নীরজা। অর্থাৎ, শুধু দেশের সমালোচনা নয়, দেশবাসী হিসেবে একজন নাগরিক কী করতে পারেন, তারও কিছু কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে।
একদিক থেকে দেশবাসীর ইচ্ছেপূরণ অন্যদিকে সিস্টেমের তরফে দেশবাসীকে তাঁদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা- একাধারে এই দুই কাজই করে চলেছে সাম্প্রতিক সময়ের হিন্দি সিনেমা। আমাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, ফ্যান্টম সিনেমার ক্যাপশন- আ স্টোরি ইউ উইশ ওয়ার ট্রু। আসলে এটাই বলতে চায় হিন্দি ছবির দুনিয়া।
‘বেবি’ বা ‘এয়ারলিফট’-এর মতো ছবির ১০০ কোটির ক্লাবে পা রাখাও প্রমাণ করে, বলিউডের এ দৃষ্টিভঙ্গি কতখানি গ্রহণযোগ্য দর্শকের কাছে।
নাচ-গানের চেনা ফর্মূলার ভিতরেও দেশ ও দেশবাসীর মধ্যে থেকে যেন কমন ফ্রেন্ডের কাজটিই করে চলেছে বলিউডি ছবির দুনিয়া।-কলকাতা
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসপি/এমএন