মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৩:৫৯:২০

নির্বাচনকে ঘিরে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

নির্বাচনকে ঘিরে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি

মনির হোসেন ও শাহ আলম খান : পৌর নির্বাচনের কারণে গ্রামে টাকার প্রবাহ বাড়ছে। কোমল পানীয়, চা, চিনিসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য, বিড়ি, সিগারেট এবং প্রিন্টিং আইটেমের চাহিদা বেড়েছে। ফোন কল ও এসএমএসের (খুদে বার্তা) কারণে বাড়ছে মোবাইল কোম্পানিগুলোর ব্যবসাও। ভোটারদের কাছে টানতে নগদ টাকা ও শীতবস্ত্র বিতরণ করছে প্রার্থীরা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, অন্যান্য সময়ের চেয়ে ব্যাংকগুলোর গ্রামের শাখায় মুদ্রা চাহিদা বেড়েছে। সবকিছু মিলে চাঙ্গা গ্রামীণ অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নির্বাচনের এই টাকা বিভিন্ন হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের মতে, বণ্টন ব্যবস্থায় হঠাৎ এই পরিবর্তন আসায় চলতি মাসে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সীমা অনুসারে এবারের পৌর নির্বাচনে সব প্রার্থী মিলে বৈধ ব্যয় করতে পারবে ২৯০ কোটি টাকা। এবার তিনটি স্তরে ৩ হাজার ৯৩৮টি পদের বিপরীতে প্রার্থী সংখ্যা ১২ হাজার ৪৫ জন। আর একজন ভোটারের জন্য মেয়র প্রার্থীর সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ৮ টাকা ৪০ পয়সা এবং কাউন্সিলর প্রার্থীর ১১ টাকা। তবে বিভিন্ন সংস্থার জরিপ রিপোর্ট বলছে ইসি নির্ধারিত ব্যয়ের সীমা কোনো প্রার্থীই মানছে না। ভোটারপ্রতি প্রার্থীরা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা বলছেন, এ বছর তারা পোস্টার ও লিফলেট ছাপিয়ে ৭০ কোটি টাকা আয় করবেন। নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ২৩৪টি পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী ৯২৩, ৭৪২টি সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ২ হাজার ৫৩৩ এবং ২৯৬১টি সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮ হাজার ৫৮৯ প্রার্থী রয়েছে। প্রার্থীদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের ব্যয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ব্যয় এবং নির্বাচনী ব্যয়। মেয়র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ২৫ হাজার ভোটার পর্যন্ত ব্যক্তিগত ব্যয়সীমা ১০ হাজার টাকা এবং নির্বাচনী প্রচারণায় ২ লাখ টাকা। এ হিসেবে প্রতি ভোটারের পেছনে সর্বোচ্চ ব্যয়সীমা ৮ টাকা ৪০ পয়সা। আর ভোটারের সংখ্যাভেদে মেয়র প্রার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে সর্বোচ্চ ব্যয় ৫০ হাজার এবং নির্বাচনী ব্যয়সীমা ৫ লাখ টাকা। আর এই অনুপাতে সবগুলোর পৌরসভা মিলে মেয়র প্রার্থীদের সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ৫০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে কাউন্সিলরদের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ভোটারের জন্য ব্যক্তিগত সীমা ৫ হাজার এবং নির্বাচন পরিচালনা ৫০ হাজার টাকা। এ হিসেবে একজন কাউন্সিলরের ভোটারপ্রতি ব্যয় সীমা ১১ টাকা। তবে ভোটারের সংখ্যা বিবেচনায় সর্বোচ্চ ব্যক্তি ব্যয় ১৫ হাজার টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনার জন্য ২ লাখ টাকা। আর সর্বোচ্চ সীমা ধরেই ১১ হাজার ১২২ কাউন্সিলর প্রার্থীর মোট ব্যয়সীমা দাঁড়ায় ২৩৯ কোটি টাকা। নির্বাচনে মোট ভোটার ৭১ লাখ ৬২ হাজার ৩৯৬। আর ভোটকেন্দ্র ৩ হাজার ৫৮২টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে দেশের ৫৭টি ব্যাংকের সারা দেশে ৮ হাজার ৮৪৯টি শাখা রয়েছে। এর মধ্যে গ্রামীণ শাখা ৫ হাজার ৪৯টি। যা মোট শাখার ৫৭ দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকিং খাতে শহুরে শাখার চেয়ে গ্রামীণ শাখাই বেশি। ব্যাংকগুলোতে গ্রামের আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং ঋণের পরিমাণ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ শাখায় মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে। চলতি মাসের শেষে এর সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে। এছাড়া এনজিও ও গ্রামীণ ব্যাংক থেকেও টাকার প্রবাহ বেড়েছে। জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন এলেই বণ্টন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে একজনের হাত থেকে বিভিন্ন জনের হাতে চলে যায় টাকা। এতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। আর মূল্যস্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়ে। এদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রিন্টিং ব্যবসার পোয়াবারো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন নির্বাচনের ইঙ্গিত পাওয়ার পরই আগ্রহী প্রার্থীরা শুভেচ্ছা এবং নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়ে পোস্টার ও বিলবোর্ড ছাপিয়েছে। এরপর নির্বাচন কমিশন থেকে চূড়ান্ত ঘোষণা এবং পরবর্তীতে প্রতীক বরাদ্দের পর দুই দফায় পোস্টার ও লিফলেটসহ অন্যান্য প্রচারপত্র ছাপিয়েছে প্রার্থীরা। এভাবে কয়েক দফার প্রিন্টিংয়ে ছাপাখানাগুলো বেশ জমিয়ে উঠেছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে ৭ হাজার প্রিন্টিং প্রেস আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৩ হাজার এবং ঢাকার বাইরে ৪ হাজার। এসব প্রেসে বছরে ৩শ’ কোটি টাকার বিভিন্ন উপকরণ ছাপা হয়। এসব প্রেসে লেমিনেটিং ছাড়া প্রতি পোস্টার ২ টাকা ৫০ পয়সা। লিফলেট ৬০ পয়সা, ব্যাজ দেড় টাকা এবং ভোটার স্লিপ ৮০ পয়সা করে নেয়া হচ্ছে। তবে কোনো কোনো ছাপাখানা মানের কথা বলে আরও বেশি চার্জ নিচ্ছে। ঢাকার আরামবাগ, ফকিরেরপুল আর পল্টনেই আছে হাজারখানেক প্রেস। আর চট্টগ্রামে প্রায় ২০০ প্রিন্টিং প্রেস দিনরাত নির্বাচনী পোস্টার ছাপানোর কাজ করে যাচ্ছে। রোববার আরামবাগ ঘুরে দেখা গেছে প্রতিটি প্রেসেই ছাপা হচ্ছে নির্বাচনী পোস্টার। কর্মীরা জানালেন, সারা রাত তারা কাজ করেন। সমিতির নেতারা জানান, তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে প্রায় ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান শহীদ সেরনিয়াবাত বলেন, নির্বাচনের কারণে প্রিন্টিং ব্যবসা খুব জমজমাট। আশা করছি এবারের পৌর নির্বাচনে পোস্টার, ব্যানার এবং লিফলেটসহ বিভিন্ন প্রিন্টিং কাজে প্রায় ৭০ কোটি টাকার কাজ হবে। তিনি বলেন, আমাদের ধারণা ছিল এ বছর ৯০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু দলীয়ভাবে নির্বাচন হওয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থী কম। ফলে আয় কিছুটা কমবে। জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী প্রচারণায় আসলে অর্থব্যয়ের কোনো সীমারেখা নেই। কারণ প্রার্থীরা নির্বাচনী দৌড়ে জিততে নানা ধরনের অবৈধ তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ে। সেখানে ভোট চাওয়ার পাশাপাশি ভোট কেনা কিংবা বিপুল অর্থ ঢেলে প্রশাসন ম্যানেজ করার দুঃসাহস দেখায়। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সার্বিক মনিটরিং পদ্ধতি খুবই দুর্বল। কে কোথায় কীভাবে বৈধসীমার বাইরে অর্থ ব্যয় করছে তা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নেই। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, নির্বাচনী ম্যানুয়াল অনুযায়ী একজন প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের যে সীমারেখা বেঁধে দেয়া হয়েছে সেটি একটি আইনি সীমা মাত্র। বাস্তবে কোনো প্রার্থীই সেটা মেনে চলে না। তিনি বলেন, প্রতিটি নির্বাচনেই টাকার ছড়াছড়ি হয়। নির্বাচনে জয়ের জন্য প্রার্থীরা সর্বোচ্চ ব্যয় করে। তিনি বলেন, কমিশনের যে সীমা দেয়া আছে, প্রার্থীরা তার ১০ গুণের বেশি ব্যয় করে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতা গ্রহণের উৎস। আর ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা যায়। তাই যারা নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা নির্বাচনকে ব্যবসা হিসাবেই বেছে নিয়েছেন। এ কারণে নির্বাচন করতেও বড় আকারের পুঁজি বিনিয়োগের দরকার। তার মতে, জয়ী হতে প্রার্থীরা দেদারছে টাকা খরচ করে। - যুগান্তর ২২ ডিসেম্বর,২০১৫/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে