আন্দোলনে যাচ্ছে ৪ লাখ ডিপ্লোমা প্রকৌশলী
ঢাকা: ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের অমূল্যায়ন করে বেতন বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিযোগ ৪ লাখ ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের। এতে তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। নেতাদের অভিযোগ, নতুন এই বেতন স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে ১০ম থেকে ২০তম গ্রেড করায় শুধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরাই নয়, ৮০-৯০ ভাগ অন্যান্য কর্মচারীকে ন্যায্য বেতন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে এসব প্রকৌশলীরা ক্ষোভ আর হতাশায় ফেঁটে পড়ছেন। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে প্রতিকার চেয়ে নানাভাবে আবেদন-নিবেদন করেও কোন কাজ না হওয়ায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নামছেন তারা। গত ১৯ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে সারাদেশে তিন দিনের কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রকৌশলীরা।
আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে ‘ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি)’-এর ব্যানারে মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় প্রেসক্লাবের সামনে কেন্দ্রীয়ভাবে এক ঘণ্টার মানববন্ধনে যোগ দিচ্ছেন প্রকৌশলীরা। মানববন্ধনের পর অর্থমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রদান করবেন তারা। এছাড়া ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর সব জেলায় মানববন্ধন ও জেলা প্রকাশকদের মাধ্যমে অর্থমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেয়া হবে।
এসব কর্মসূচির পরও দাবি পূরণ না হলে পরবর্তীতে সারাদেশের ৪ লাখ পেশাজীবী ডিপোমা প্রকৌশলীসহ ৮টি পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে আইডিইবি’র ব্যানারে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচিতে নামবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন আইডিইবির নেতারা।
আইডিইবি’র সাধারণ সম্পাদক মো. শামসুর রহমান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ গড়তে হলে সবক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে বেতন গ্রেড ২০টি থেকে কমিয়ে আনা অপরিহার্য হলেও ৮ম বেতন স্কেলে কৌশলে তা করা হয়নি। ১০ম গ্রেডের অধিকাংশ কর্মচারী ১৫ থেকে ৩০ বছর একই বেতন গ্রেড ও মর্যাদায় অবস্থান করে থাকেন।
অন্যদিকে ৯ম থেকে ১ম গ্রেডভুক্ত ঊর্ধ্বতন কর্মচারীরা সাধারণ নিয়মেই পদোন্নতি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ ধাপের বেতন স্কেল পেয়ে যাবে। যদি সকলের জন্যই টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বন্ধ রাখা হয়, তাহলে সেসব ঊর্ধ্বতন কর্মচারীদের মত একই নিয়মে ২০তম থেকে ১০তম গ্রেডের কর্মচারীদের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পদোন্নতি দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
আইডিইবি’র সভাপতি এ কে এম এ হামিদ বলেন, ‘সরকার গত ১৫ ডিসেম্বর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য চাকরি (বেতন ভাতা) আদেশ ২০১৫ জারি করেছে। এই বেতন স্কেলে যেমন অনেক যুগোপযোগী অর্জন রয়েছে, তেমনি রয়েছে পেশাজীবী ভেদে অনেক বৈষম্য। আমরা সরকারের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত যেমন শ্রেণি প্রথা বিলুপ্ত, বাংলা নববর্ষ ভাতা প্রবর্তন, শতাংশ হারে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি, বেতন ভাতাদি নির্ধারণে অভিন্ন সফটওয়্যার চালু ও এককভাবে বেতন নির্ধারণের সুযোগ সৃষ্টিকে স্বাগত জানাচ্ছি। একই সাথে যে সকল ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সংশোধনের জন্য আপনাদের মাধ্যমে সরকারের নিকট জোরালো দাবি জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘বেতন স্কেলের গেজেট পর্যালোচনা করে আমরা জানতে পেরেছি এদেশে উন্নয়ন উৎপাদনে নিয়োজিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারগণ মারাত্মকভাবে বেতন বৈষম্যের স্বীকার হয়েছে। ১০ম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তার সংক্ষিপ্ত আকারে সভাপতি জানান, ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রাথমিক নিযুক্তিতে ১০ম গ্রেডে বেতন পাবেন ১৬ হাজার টাকা। তিনি ১০ বছর চাকরি পূর্তিতে ৯ম গ্রেডে উন্নীত হয়ে বেতন পাবেন ২২ হাজার টাকা এবং ১৬ বছর চাকরি পূর্তিতে ৮ম গ্রেডে উন্নীত হয়ে ২৩ হাজার টাকা স্কেলে বেতন ভাতাদি পাবেন। অর্থাৎ ১৬ বছর চাকরি করার পর একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার যে বেতন গ্রেডে উন্নীত হবেন সেটি ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ারদের প্রাথমিক নিযুক্তির পদ অর্থাৎ সহকারী প্রকৌশলীর জন্য নির্ধারিত।’
অথচ ৭ম বেতন স্কেলে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার উপ-সহকারী প্রকৌশলী ১০ম গ্রেডে প্রাথমিক নিযুক্তির পর ৪ বছর চাকরি পূর্তিতে সিলেকশন গ্রেড পেয়ে ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ারদের প্রাথমিক নিযুক্তি পদ সহকারী প্রকৌশলী পদে সম বেতন-ভাতাদি পেতেন। একই ধারাবাহিকতায় উপ-সহকারী প্রকৌশলীগণ ৮ বছর চাকরি পূর্তিতে প্রথম টাইম স্কেল পেয়ে ৮ম গ্রেড ও ১২ বছর চাকরি পূর্তিতে ২য় টাইম স্কেল পেয়ে ৭ম গ্রেডে বেতন-ভাতাদি পেতেন।
সুপ্রীমকোর্টের রায় অনুসারে অনেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী ১৫ বছর চাকরি পূর্তিতে ৩য় টাইম স্কেল পেয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন-ভাতাদি পেয়ে আসছে। ৮ম জাতীয় বেতন স্কেলে ৬ষ্ঠ গ্রেডের প্রারম্ভিক বেতন ৩৫ হাজার ৫শ টাকা। সার্বিক বিবেচনায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, ১৬ বছর চাকরি পূর্তিতে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ২টি উচ্চতর বেতন স্কেল প্রাপ্তির পরও ৬ষ্ঠ গ্রেডের সাথে তার বেতন বৈষম্য হবে ১২ হাজার ৫শ টাকা। যা একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারকে চাকরি জীবনের শেষ অবধি পেতে হবে।
পাশাপাশি একজন ডিগ্রী ইঞ্জিনিয়ার সহকারী প্রকৌশলী ক্যাডার এন্ট্রি পদে ৮ম গ্রেডে নিয়োগ লাভ করে পরবর্তী পদোন্নতি পেয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে এবং ১৬ বছরে ২টি উচ্চতর স্কেল ও পদোন্নতি পেয়ে ৪র্থ গ্রেডে ৫০ হাজার টাকা বেতন পাবেন। অপরদিকে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার সমগ্র চাকরি জীবনে ৮ম গ্রেডে অর্থাৎ ২৩ হাজার টাকার ধাপ অতিক্রম করতে পারবেন না। ফলে উভয়ের মধ্যে বেতন বৈষম্য দাঁড়াবে ২৭ হাজার টাকা। এরকম বৈষম্যমূলক একটি বেতন স্কেল এদেশের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এ ধরনের বৈষম্যমূলক বেতন আদেশ জারির তীব্র প্রতিবাদ জানান সভাপতি।
জানা গেছে, একজন সহকারী প্রকৌশলী পদোন্নতি পেয়েই ৬ষ্ঠ গ্রেডে অর্থাৎ ৩৫ হাজার ৫শ টাকার স্কেল পাবেন। ১০ম গ্রেডে যোগদান করে একজন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ২০ থেকে ২৫ বছরে যদি একটি পদোন্নতি পানও তাহলে সে ৯ম গ্রেডে ২২ হাজার টাকার স্কেল পাবেন। এই অবস্থায়ও একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ২ ধাপ নিচে থাকবেন। একজন সহকারী প্রকৌশলী যিনি ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে ৯ম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে ৬ষ্ঠ গ্রেডে যাবেন। এই অবস্থায়ও তার মূল বেতনের পার্থক্য হবে ১৩ হাজার ৫শ টাকা। যদিও উপ-সহকারী প্রকৌশলীরা অধিকাংশই ২০ থেকে ২৫ বছরের আগে কোন পদোন্নতি পান না। ২৫ বছরে সরাসরি যোগ দেয়া সহকারী প্রকৌশলীর অনেকেই ৫ম বা ৪র্থ গ্রেডে চলে যাবেন। এভাবে চাকরি জীবনে ২৩ হাজার স্কেলের উপরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না প্রায় ৮০ থেকে ৮৫ ভাগ উপ-সহকারী প্রকৌশলী বা সমমানের পদে চাকরিরত ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা।
বর্তমান বেতন স্কেলে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ক্যাডারভুক্ত সহকারী প্রকৌশলীগণ প্রাথমিক নিযুক্তিতে ৮ম গ্রেডে ২৩ হাজার টাকা স্কেলে বেতন ভাতাদি পাবেন। অন্যদিকে ক্যাডার বহির্ভূত সহকারী প্রকৌশলীগণ ৯ম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা স্কেলে বেতন ভাতাদি পাবে। এর মাধ্যমে ক্যাডার নন-ক্যাডার পদের মাঝে চরম বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছেন আইডিইবি’র নেতারা।
সূত্র: বাংলামেইল
২২ ডিসেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪ডটকম/জুবায়ের রাসেল