মেহেরপুর: সাপ দেখেনি কেউ। কিন্তু দংশনের শিকার হয়েছেন মেহেরপুরের উজলপুর গ্রামের অর্ধশতাধিক মানুষ। ওঝা বলেছেন, এটি জ্বীন সাপ। সাপের রূপে জ্বীন এসে মানুষকে কামড়াচ্ছে।
ব্যাস!! রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে মেহেরপুরের উজুলপুর গ্রামের নারী পুরুষ, বৃদ্ধ বনিতার। আতঙ্কে অনেকেই ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
উজলপুর গ্রামটি মেহেরপুর সদর উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। জ্বীন সাপ থেকে বাঁচতে গ্রামের বাসিন্দারা ওঝা ও সাপুড়েদের কাছে দৌড়াচ্ছেন। ঝাড়-ফুঁক নিচ্ছেন কবিরাজের কাছ থেকে। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই আছেন এ লাইনে।
জ্বীন সাপে আতঙ্কের সুযোগ নিয়েছেন স্থানীয় ওঝা, সাপুড়ে, কবিরাজরাও। জ্বীন সাপে দংশিত হচ্ছে মানুষ- এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে তারা লুটে নিচ্ছে জনসাধারণের অর্থ।
প্রকৃতি ঘেরা শান্ত গ্রামটির অধিকাংশ মানুষ কৃষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঘটনার শুরু হয় গত ১৩ মে সকালে। স্থানীয়রা জানতে পারেন উজলপুর গ্রামের কুঠিপাড়া এলাকার কৃষক কামাল হোসেনের ছেলে মুরসালিন সাপের কামড়ে মারা গেছে। মাঝরাতে সর্প-দংশনের শিকার হয় অষ্টম শ্রেণির এ ছাত্র।
সাপে কাটার পর তাকে ২৫০ শয্যার মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভোরের দিকে মৃত্যু হয় মুরসালিনের।
১৪ মে সন্ধ্যায় গ্রামের স্টুডিও ব্যবসায়ী রুবেল আহমেদ টয়লেট থেকে বের হওয়ার সময় হাতে সাপের কামড় অনুভব করেন। এতে তার হাতে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে হাত অবশ হয়ে যায়।
রুবেল জানান, তার হাতে সাপ দংশন করায় পার্শ্ববর্তী শোলমারী গ্রামের ওঝা রতন হোসেনকে কল দেন। তিনি দোয়া পড়ে হাতে ফুঁ দিতে বলেন। সে মোতাবেক দোয়া পড়ে হাতে ফুঁ দিতেই জ্বালাপোড়া শেষ হয়ে যায় বলেও তিনি জানান।
এমন দংশনের ঘটনা ঘটেছে আরও। কৃষক হেলাল উদ্দীন কাজ করছিলেন তার ক্ষেতে। হঠাৎ তাকে সাপে কামড়ায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। হেলাল জানান, হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
গ্রামের কুঠিপাড়া এলাকায় এক গৃহবধূকেও সাপে কামড়েছে বলে জানা যায়। তিনি জানান, তার বাঁ হাতের কনুইয়ের উপর জ্বালাপোড়া শুরু হয়। তার স্বামী ও পরিবারের লোকজন পাশের গ্রামে রতন ওঝার কাছে নিয়ে যায়। ওঝা তাকে ঝাড়ফুঁক দিয়ে গলায় কাঁড় পরিয়ে দেন। এর কিছুক্ষণ পর তার জ্বালাপোড়া বন্ধ হয়ে যায়।
নুর আলী নামে এক কৃষকও সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানান। জ্বীন সাপ তার বুকে কামড়ায়। পরে শোলমারী গ্রামের ওঝা আবুল হাসেমের কাছে গিয়ে তিনি ঝাড়ফুঁক নিয়ে সুস্থ হন। তিনি জানান, সাপের আতঙ্কে তারা দিন পার করছিলেন। তাকে কামড়ালে পরিবারের সবাই আবুলর ওঝার কাছ থেকে কাঁড় পড়া নেন।
নুর আলী আরও জানান, সাপে কামড়ানো রোগীর শরীরে বিষ থাকলে ওঝাদের ৫০০ টাকা ফি দিতে হয়। বিষ না থাকলে দিতে হয় তিনশ টাকা করে।
তাদেরসহ গত দুই সপ্তাহে উজলপুর গ্রামে অর্ধশতাধিক মানুষকে জ্বীন সাপ কামড়েছে বলে জানা যায়।
গ্রামের বেশ কয়েকজন জানান, সাপে কাটার কথা শোনা গেলেও কেউ এখনও সে সাপ দেখেননি। কবিরাজ-ওঝারা বলছেন, এটি জ্বীন সাপ। গ্রামের সাধারণ মানুষ তা বিশ্বাসও করছেন।
শোলমারী গ্রামের দুই ওঝা আবুল হাসেম ও রতন হোসেন জানান, গ্রামে এখন পর্যন্ত যাদের সাপে কেটেছে তাদের মধ্যে একজন মারা গেছে। বাকিদের ঝাড়ফুঁক দিয়ে সুস্থ করা সম্ভব হয়েছে। এটা প্রকৃতপক্ষে সাপ না বলে মত দেন এ দুজন। তাদের ভাষ্য, সাপের রূপে জ্বীন এসে মানুষকে কামড়াচ্ছে। যে কারণে আক্রান্তদের বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে।
পঞ্চাশ বছর ধরে কবিরাজি করে আসছেন মেহেরপুর শহরের ইনছান সাপুড়ের। আদৌ জ্বীন সাপ আছে বলে নিজের অভিজ্ঞতা জীবনে শোনেননি বলে তিনি জানান।
কুতুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম রেজা জানান, সাপের কামড়ে এক ছাত্রের মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন দংশিত হন বলে জানা যায়। এরপর থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়। জ্বীন সাপ মানুষ কামড়াচ্ছে বলে দুই ওঝা মত দিলে জনমনে আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। আমি জনগণকে আতঙ্কিত না হতে আহ্বান জানিয়েছি। গ্রামবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিতে নানাভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি।
মেহেরপুর সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. অলোক কুমার দাশ বলেন, এটা শুধুমাত্র গুজব। ঘটনাটি জানার পর স্বাস্থ্য বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উজলপুর গ্রাম পরিদর্শন করা হয়েছে। একটি চক্র আতঙ্ক ছড়িয়ে ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। গ্রামবাসীর মনোবল ধরে রাখতে উজলপুর গ্রামে একটি মেডিকেল টিম সার্বক্ষণিক কাজ করছে বলেও তিনি জানান।